একুশকাহন – সপ্তর্ষি নাগ

অবশেষে একুশ | আজ আবার নিজের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের দিন | শ্রদ্ধা না থাকলেও মাতৃভাষাপ্রেম দেখানোর দিন | আজ উথলে উঠবে বাংলা ভাষার প্রতি ভক্তি | সোশ্যাল মিডিয়াতে চলবে মাতৃভাষা নিয়ে অহংকারের প্রতিযোগিতা | যে বাঙালি মা ছেলের ভাষা নিয়ে কথা বলতে গেলে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেন, বাংলাটা না ও তেমন লিখতে পড়তে পারে না, বোঝে অবিশ্যি সবটাই, তিনিও আজ পোস্টাবেন – আহা মরি বাংলা ভাষা ! কি জ্বালা ! আদিখ্যেতার ও চক্ষুলজ্জা থাকা দরকার |

এহেন এক গর্বিত বাঙালির পুত্রের নাম পূরব | গোবেচারার মতো তার বাবাকে শুধিয়েছিলাম, এহেন নামের কারণ কি? জবাব এল – বাংলা নাম রাখলে পরে বিদেশ টিদেশ যেতে হলে ওখানে লোকে উচ্চারণ করতে পারবে না | অমর্ত্য সেন শুনলে আঁতকে উঠতেন বইকি | পরে ওনার স্ত্রী অবশ্য সামাল দিতে গেলেন, আসলে মেয়েদের নাম পূরবী হলে ছেলেদের নাম পূরব হলে দোষ কি? দোষের আর কি ! হ্যারি পটারকে বুকে নিয়ে অমর চিত্র কথাকে ভুলে যাওয়া বাঙালির দোষ আর কি ? শুধু বিশেষ দিনে ভাষা নিয়ে ন্যাকামোগুলো খালি বেমানান এই যা |

মেয়েটা বাংলায় বড় কাঁচা, আসলে স্কুলে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, বাংলায় বললে আবার ফাইন – এটা আজকাল বেশ একটা স্টেটাস সিম্বল | সত্যি কথা বলতে কি, আমার এক সন্তানকে ও ইংরেজি মিডিয়ামে দিয়েছি | শর্ত কেবল একটাই | বড় হওয়ার পথে বন্ধু হবে টেনিদা, ফেলুদা, ঘনাদা | পথ দেখাবে শীর্ষেন্দু, সুনীল, সঞ্জীব, সমরেশ | ঘুমের আগে বিছানায় থাকবে নারায়ণ দেবনাথ | সরস্বতী পুজোয় ঠাকুরের আসনে ছেলেমেয়ে বই রেখেছিল | চমকে উঠলাম বইয়ের নাম দেখে | সবার উপরে হাঁদা ভোঁদার কান্ডকারখানা | নারায়ণবাবু বেঁচে থাকলে ভারি খুশি হতেন |

আজকাল বাঙালি লেখকদের গালমন্দ করে আমরা বেশ মজা পাই | লেখা নাকি আর আগের মতো হচ্ছে না | আচ্ছা একটা লেখা ভালো হলে এটা আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারবো যে লোকে সেটা পড়বে? সমাদরই তো শিল্পীর সবচেয়ে কাম্য পুরস্কার | সেই সমাদরের মানুষই না থাকলে লেখার উৎসাহ আসবে কোত্থেকে? অতএব ওই একদিন গান গেয়ে, পোস্ট করে, বাঙালি পোশাক পরে বাংলাভাষার গুণগান গাবো আর বাকিদিন পিন্ডি চটকাবো, থাকুক বাবা এমন ভাষাপ্রেম |

ইদানিং আবার আরেকদল ভাষাবিশেষজ্ঞ পাওয়া যায় | এদের অন্য ভাষায় অপারগতা বাংলাভাষার প্রতি প্রেমের কারণ | একটা আদ্যপান্ত বাঙালি ঝকঝকে ইংরেজি লিখলে বা বললে এদের গা জ্বলতে থাকে | মনে করবেন না যে এরা বাংলাতেও পুরো ফাটিয়ে দিয়েছেন | খুঁত ধরে দুর্বলতা ঢাকা এদের পেশা | দেখবেন মাঝে মাঝেই এরা অন্যান্য ভাষা বয়কট, অন্য ভাষায় লেখা বই পড়া বয়কট ইত্যাদি স্লোগানে অন্তর্জালদুনিয়া কাঁপান | আরে বাবা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যেমন ধর্মে প্রয়োজন, অস্তিত্বে প্রয়োজন তেমনি ভাষাতেও তার প্রয়োজন | আমার ভাষা ভালো মানে এই নয় যে অন্য ভাষা খারাপ |

এক বাঙালি গীতিকারকে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা বাংলা গানে আজকাল এত তুইতোকারি চলে কেন? তাঁর জবাব, ওটাই স্টাইল বস, হিন্দিতে তু মেরি জিন্দেগী হ্যায় শোনেননি? বাংলায় কি দাঁড়ায় ব্যাপারটা? হিমশিম খাওয়ার জোগাড় ! অনেকদিন মনে একটা প্রশ্ন ছিল, আগে বাংলা গান থেকে হিন্দি কপি করা হত, আজকাল উল্টে গেছে কেন? উত্তরটা পেয়ে গেলাম |

বিভূতিভূষণের দেবযান সেদিন আবার নতুন করে পড়ছিলাম | শিউরে উঠছিলাম মানুষটার চিন্তার ব্যাপ্তি দেখে | পরের বইটা ছিল তুর্কির লেখক আইসে কুলিনের লাস্ট ট্রেন টু ইস্তানবুল | ভাষা এমনই | দেশ, জাতির গন্ডি মানে না | সব ভাষার প্রতি ভালোবাসা না থাকলে যেমন নিজের ভাষাকে শ্রেষ্ঠ বলার অধিকার মেলে না, তেমনই নিজের ভাষাকে না চিনলে ভিন রাজ্য বা দেশ বা ভাষাও আপন করবে না | সত্যিকারের বাঙালি হলে রোজ তাই একুশে ফেব্রুয়ারী |

News Reporter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *