ভুলে যাওয়া বাঙালি- পর্ব পাঁচ -পঞ্চানন কর্মকার

কলমে- স্বাগতা ঘোষ

সেদিন আমার খুদে ছাত্রটিকে দিচ্ছিলেম ভাষার পাঠ। ভাষার কথা উঠলেই প্রথমে আসে ধ্বনি। তাই মানুষের মুখনিঃসৃত ধ্বনি থেকে শুরু করে বর্ণমালার বাহান্ন বর্ণের উপাদেয় ব্যঞ্জনভোগ,সে আলোচনায় সামিল হচ্ছিল সবই। অতঃপর খুদে মন ছাপিয়ে আসছিল অজস্র প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক  প্রশ্নের জোয়ার।  অবশ্য মন্দ লাগছিল না সেসবের উত্তর দিতে , কারণটা  বোধহয় নিজের শিকড়ের স্মৃতিচারণের সুখ। আপন সংস্কৃতির আলাপে,চর্চায় কি যে এক অনির্বচনীয় মুক্তির স্বাদ আছে, তা হেমন্তের শীতলধারার মতো আঁধারে খোলা আকাশের নীচে না দাঁড়ালে অনুধাবন করা যায় না। এ ধারায় যে ভিজেছে কেবল সেই জানে তার সুখ।আজকালকার এই সাহেবসুবো বাপ-মায়ের ঘরে বসে কোনো ছেলে যদি নিজের মাতৃভাষা নিয়ে  দু-চার কথা জানতে চায় তা কম আনন্দের,না কম আতিশয্যের !!

     যখন তাকে বললেম, “ ধ্বনিকে লিখে প্রকাশ করার চিহ্নই হল বর্ণ ”, সে বললে, “কে লিখলে এ চিহ্ন বইয়ে? ” আমি তো অবাক ! এমন প্রশ্ন তো আগে কেউ করেনি। কম করে হলেও বছর তিনেক হল এই পেশায়  ,কই এর আগে তো আর একটিও বঙ্গসন্তান জানতে চায়নি ‘ বাংলার গুটেনবার্গ ‘ কে!তারা রবীন্দ্রনাথ জানে,বিদ্যাসাগর মানে,দু লাইন পদ্য আওড়েই  হাঁপিয়ে উঠে  ইংরেজি নভেলে আশ্রয় খোঁজে!ব্যাস! এটুকুই তাদের মনোরম অপরাহ্নে বঙ্গরসবিহার।যাইহোক, ছাত্রটিকে একবুক উৎসাহ নিয়ে উত্তর দিলেম, “ এ চিহ্ন বইয়ে লিখেছেন পঞ্চানন কর্মকার। তুমি শুনবে ওনার কথা?” সে সোৎসাহে মাথা নাড়ালে।আমি বলতে শুরু করলেম –

   বাংলায় মুদ্রণাক্ষরের  জনক পঞ্চানন কর্মকারের জন্ম তৎকালীন বাংলার হুগলি জেলার ত্রিবেণী নামে একটি গ্রামে।পিতা ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শম্ভুচরণ কর্মকার। তাঁর জন্মের সাল বা জন্মদাত্রী মা সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য মেলে না। পঞ্চাননের পূর্বপুরুষরা ছিলেন লিপিকার,ধাতু অলঙ্কারক,দক্ষ খোদাইকারক।তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল হুগলি জেলার জিরাটে।পরে পরিবারটি ত্রিবেণী তে বসবাস শুরু করে।প্রথমে তাঁদের পদবী ছিল মল্লিক।তাঁদের পরিবারের সুদক্ষ শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন স্বয়ং নবাব আলীবর্দী খাঁ।কালক্রমে তাঁরা কর্মকারের পেশা গ্রহণ করে লোহার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন।কারণে -অকারণেই নামের সাথে জুড়ে যায় কর্মকার পদবী।স্বাভাবিকভাবেই উত্তরাধিকারসূত্রে পঞ্চানন হয়ে ওঠেন ত্রিবেণীর দক্ষ ধাতুশিল্পী।

     সময়টা অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষ।ততদিনে ভারতের সম্পূর্ণ শাসনভার ইংরেজের হস্তগত।এমতবস্থায় শাসনকার্যের সুবিধার্থে ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে পড়ে,ফলস্বরূপ প্রয়োজন হয় বাংলাভাষার পুস্তকের।অথচ তখনও মুদ্রণের জন্য বাংলা হরফের আবিষ্কার হয়নি। দেশের প্রথম ছাপাখানা অবশ্য তার অনেক আগেই পর্তুগিজদের প্রচেষ্টায় গোয়ায় স্থাপিত হয়েছিল ১৫৫৬ সালে।পরবর্তীতে ইংরেজ মিশনারীদের চেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বহু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা পায়।বাংলার প্রথম ছাপাখানা আত্মপ্রকাশ করে ১৭৭৮ সালে হুগলিতে ফাদার এন্ড্রুজ সাহেবের তত্ত্বাবধানে।এই ঐতিহাসিক ছাপাখানায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার ও আধুনিক ছাঁচের ফরাসি হরফের স্রষ্টা চার্লস উইলকিন্সের তত্ত্বাবধানে দুর্নিবার মেধা ও অকুণ্ঠ পরিশ্রমকে পাথেয় করে পঞ্চানন মুদ্রণের জন্য ছেনি কেটে,ঢালাই ফেলে তৈরি করেন চলনশীল বা বিচল ধাতব বাংলা হরফ। বাংলায় এই প্রথম মুভেবেল টাইপ বা বিচল হরফের আত্মপ্রকাশ,তাই পঞ্চানন কর্মকারকে বলা হয় “ বাংলার ক্যাসটন” বা “বাংলার মুদ্রণ শিল্পের জনক ”। শুধু বাংলাতেই নয়,এমনকি সমগ্র ভারতীয় ভাষার বিচারে এই হরফ ছিল প্রথম ভারতীয় ভাষায় ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক হরফ।এই হরফ ব্যবহৃত হয় হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণে।১৭৭৮ সালে হুগলির চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত হয় A Grammar of the Bengal Language’ । বইটি অনায়াসে বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম বইয়ের খেতাবটি অধিকার করতে পারে।এর পরের বছর অর্থাৎ ১৭৭৯ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের ঐকান্তিক উৎসাহে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি ছাপাখানা, ‘ কোম্পানির প্রেস ‘ । অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন উইলকিন্স এবং তাঁর সুপরামর্শে পঞ্চানন তাঁর শিল্পনৈপুণ্য নিয়ে হাজির হন কলকাতায়, হেস্টিংসের উৎসাহে নিযুক্ত হন কোম্পানির প্রেসে।

    ১৭৮৫ সাল, পঞ্চানন ও উইলকিন্সের হাতগুনে প্রকাশিত হল হেস্টিংসের বহু প্রতীক্ষিত          ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা ‘র প্রথম ইংরেজি অনুবাদ,যায় ভূমিকা রচনা করলেন ওয়ারেন হেস্টিংস নিজে ।

    ১৭৯৯ সাল, উইলিয়াম কেরির সাথে সাক্ষাৎ হয় পঞ্চানন কর্মকারের,এই সাক্ষাৎ শ্রীরামপুর মিশন প্রেসকে এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর তৈরির কারখানায় উন্নীত করে।শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের জন্ম ১৮০০ সালের ১০ই জানুয়ারি । সেসময় খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের জন্য বাংলা ভাষায় খ্রিস্টের বাণী সম্বলিত গ্রন্থ বিতরণ করা হয়ে পড়েছিল রীতিমত দস্ত্তর।তাই কেরি সাহেব পঞ্চানন ও তাঁর জামাতা মনোহর কারিগরকে উন্নতমানের হরফ তৈরির জন্য নিয়ে আসেন শ্রীরামপুরে। তাঁর দুরন্ত ইচ্ছা আর অবিরাম প্রচেষ্টায় তৈরি ধাতব হরফে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের কেরি প্রণীত অনুবাদ মুদ্রিত হয়।  পঞ্চানন প্রত্যেকটি হরফের দাম ধার্য করেছিলেন এক টাকা চার আনা । এ দাম ছিল সচল হরফে ইউরোপ থেকে ছাপিয়ে আনা বইয়ের তুলনায় ঢের কম। তাঁর হরফগুলি ছিল সুঠাম, সুন্দর ও স্পষ্ট।১৮০৩ সালে ভারতের বুকে প্রথম দেবনাগরী হরফ প্রস্তুত করেন পঞ্চানন, উইলকিন্সের সংস্কৃত ব্যাকরণের জন্য। এরপর আরবি,ফারসি,মারাঠি, বর্মী, গুরুমুখী, তেলেগু সহ মোট চোদ্দোটি ভাষার মুদ্রণযোগ্য হরফ তৈরি করেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। বাংলা বেশ কিছু হরফের ছাঁচ ও নকশায় রয়েছে পঞ্চাননের নিজস্বতা ও প্রত্যক্ষ প্রভাব,তাই বুঝি শ্রীরামপুর আজ ‘অক্ষরের শহর’ । তবে ভাষার ইতিহাস তবুও মুদ্রণাক্ষরের জনকের ইতিহাস সম্পর্কে মুদ্রিতপল্লব নেত্রেই দুশো বছর অতিবাহিত করেছে। কবির কথায়, “ ইতিহাস মারিছে ইতিহাসের গলা টিপে” । পঞ্চাননের জামাতা মনোহর ও দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্র পরবর্তীতে শ্রীরামপুরের ‘বটতলায়’ একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। ইহাই পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় ‘ অধর টাইপ ফাউন্ড্রি’ তে । কালের স্রোত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে  “বর্ণপরিচয়” হাতে টেনে আনে এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে, প্রস্তুত হয় আর এক ইতিহাসের সূচনার অক্ষর।

    বাঙালি আজকাল আর নিজের ভাষায় লিখতে বা পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। বঙ্গের ভিটেমাটি বেচে অন্য ভাষার দরজায় কড়া নাড়াতেই সে বেশি গর্ববোধ করে, অথচ এই ভাষার হরফ তৈরির জন্য অজ্ঞাতভাষী এক ভিনদেশীর উৎসাহে এক বঙ্গসন্তান কত নিদ্রাহীন রাত্রি অতিবাহিত করেছেন কাঠ বা কঠিন ধাতুর গাত্রে ছেনির মৃদুমন্দ আঘাতে।কতশত পথ আঁধারে পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এনেছেন অক্ষর-হরফের আলো। তবুও বাঙালির ইতিহাস তাঁকে বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত রেখেছে নির্দ্বিধায় । অথচ ত্রিবেণীর পঞ্চানন না থাকলে হয়তো বঙ্গের ‘ বর্ণ পরিচয় ‘ থেকে যেত চিরকালের ‘অধরা মাধুরী’ হয়ে।

‘ভুলে যাওয়া বাঙালি’ এই শিরোণামে প্রতি বুধবার ও রবিবার আমাদের ওয়েবসাইট www.saptarshinag.in এ প্রকাশিত হবে একটি করে অধ্যায় | আর সেই লেখা হবে তোমাদের | বাংলার এমন কৃতি সন্তানরা যাঁদের আজ মানুষ ভুলে গেছে তাঁদের নিয়ে গবেষনামূলক লেখার সিরিজ এটি | লিখতে হবে বাংলায় | সেরা লেখাগুলো স্থান পেতে পারে kindle এ প্রকাশিত বইয়ে | তাই চটপট পাঠিয়ে দাও নিজের লেখা nagsaptarshi@gmail.com এই মেইল আইডি তে | ওয়ার্ড ফাইল এ শুধুমাত্র পাঠানো যাবে লেখা | লেখার গুণমান বিচার করে শুধুমাত্র ভালো লেখাই কিন্তু প্রকাশ পাবে | শব্দের কোনো সীমারেখা নেই | লেখা পাঠানোর ও ডেডলাইন নেই | এই সিরিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও তোমাদের |

A must read article

News Reporter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *