৭৭৭ চার্লি- মুভি রিভিউ না

সপ্তর্ষি নাগ

৭৭৭ চার্লি ছবিটা ভালো জেনেও অনেকদিন মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। কিছুদিন আগে নিজের পোষ্যকে নিজের কোলে হারানোর কষ্ট এখনো মনকে আতুর করে তোলে। তাই হয়তো বরফের মাঝে একজন মানুষ আর তার পোষ্য সারমেয়র অসাধারণ একটা মন ভালো করা পোস্টার দেখে ও ভয় হত এগোতে । আবার তো সেই বুক কেমন করা, গলা শুকিয়ে আসা বা চোখের কোণ ভিজে ওঠা। তাছাড়া নেশাগ্রস্তের পর্যায়ের সিনেমাপ্রেমী হওয়াতে এর আগে ওল্ড ইয়েলার থেকে হাচিকো,এইট বিলো থেকে টোগো, মাই ডগ স্কিপ থেকে মারলি এন্ড মি,রেড ডগ থেকে কল অফ দ্য ওয়াইল্ড – হলিউডের প্রায় সব সারমেয় কেন্দ্রিক ছবি দেখে ফেলা | ছোটবেলায় হিন্দিতে তেরি মেহেরবানীয়াও সেই বয়সের মতো করে ভালো লেগেছিল | ফলে আজকের এই হাইপসর্বস্ব বাজারে তৈরি হওয়া কোনো ছবি আমাকে নতুন কিছু দেবে সেই বিশ্বাস খুব একটা বেশি ছিল ও না।শেষমেশ ছেলেমেয়ের আবদারে খুলে বসলাম চার্লি |

শুরুর দিকে একটু জড়তা আছে বইকি! দক্ষিণি মাত্রাতিরিক্ততাও কিছু ক্ষেত্রে স্পষ্ট | কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় দুই মূল চরিত্র ধর্মা আর তার পোষ্য চার্লির মিষ্টি সম্পর্ক। আর এই ভালোলাগা ও ভালোবাসার অনুঘটক থাকে একটা ছোট্ট, মিষ্টি মেয়ে আদৃকা। চার্লি আর ধর্মার সম্পর্ক যত গাঢ় হয়, ছবিটার বাঁধন ও ততই মজবুত হতে থাকে। কন্নড ভাষাতে ছবি তৈরি হলেও ধীরে ধীরে আর সব কালজয়ী ছবির মতোই চার্লি ও ভাষার সীমানা ছাড়িয়ে যায় | ছবির প্রথমার্ধ শুধু ভালোবাসার গল্প, ভালো লাগার গল্প। আর ছবিটার আসল আকর্ষণ দ্বিতীয় অর্ধে। ভালোলাগার পশুর ভালো লাগাগুলোকে বোঝা আর তার জন্য সবকিছুকে হার মানিয়েও তাকে সেই ভালো লাগার জিনিস পাইয়ে দেওয়া। সত্যি বলছি ঠিক এই আঙ্গিকে আজ পর্যন্ত হলিউড ভাবেনি | এত এত হলিউডি ছবি দেখা আমি পর্যন্ত বলতে বাধ্য হচ্ছি পোষ্যর বাকেট লিস্ট শুধু এই চিন্তাটা করবার জন্যই বহু বিদেশি ছবিকে টেক্কা দেবে চার্লি | চার্লি চরিত্রে সারমেয়র অভিনয় তার ট্রেনারকে কুর্নিশ জানাতে বাধ্য করে | ধর্মার চরিত্রে রক্ষিত শেঠি অনবদ্য | আদৃকার চরিত্রে ছোট্ট মেয়েটি নজর কাড়ে। পশু সুরক্ষা আধিকারিকের চরিত্রে সংগীতা শ্রীঙ্গেরিও প্রানবন্ত | ছবির চিত্রনাট্য কিছু ক্ষেত্রে একটু দুর্বল হলেও আবহসঙ্গীত আর সিনেমাটোগ্রাফি মন ছুঁয়ে যায় | কিছু গান মনকে নাড়া দেয় | এডিটিং বিভাগে আরেকটু মন দিলে ছবিটা আরো টানটান হত | কিন্তু চারশো রানের মহাকাব্যিকে ইনিংসেও ব্রায়ান চার্লস লারা বেশ কয়েকটা লোপ্পা ক্যাচের সুযোগ দিয়েছিলেন। চার্লির অমরত্ব তাই চিন্তার ব্যাপ্তিতে, ভাষার বাঁধনকে উপড়ে ফেলাতে, নতুন করে ভাবতে শেখাতে।

এন্ড ক্রেডিটের পরে ও ছবির কিছু দৃশ্য মনকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখায়, খয়িষ্ণু সমাজের মূল্যবোধকে জাগায়, ইনব্রিডিং নিয়ে ছবির স্রষ্টার মানবিক মেসেজ আন্দোলিত করে চিন্তার প্রবাহকে। আর চিকচিক করা চোখের ফাঁকে নতুনের স্বপ্ন ভাসতে থাকে। ধন্যবাদ কে কিরণরাজকে ভারতের হাচিকোকে জন্ম দেওয়ার জন্য, অবলা পশুর আড়ালে চাপলিনকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য, যিনি এই ছবির প্রেক্ষাপটে সারাক্ষণ আছেন তাঁর সৃষ্টির মতোই অমর হয়ে |

পরিশেষে, নকলে নকলে জেরবার বলিউড আর সীমাহীন আঁতেল পরিচালকদের কাছে চার্লি একটা শিক্ষা – হৃদয় জয় করা ছবি বানাতে সুন্দর একটা হৃদয়, ভালো গল্প, সূক্ষ্ম চিন্তা আর স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর চোখ দরকার , শুধু লক্ষীলাভের আশা কিংবা পাকামি বা বুদ্ধিজীবিত্ত্বের প্রতিষ্ঠার বাসনা না |

News Reporter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *