ভুলে যাওয়া বাঙালি- পর্ব ২- ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

কলমে- সৈকত দাস

   আমার বাড়ী উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শ্যামনগর এ। মূলত জায়গাটি এখনও মফস্বল কিন্তু তা বলে তার একটা নিজস্ব ইতিহাস থাকবে না তা ভাবাটা বোধহয় একটু অর্বাচীন হবে। তো সেদিনের আড্ডাতেও আমি যথারীতি আমার আধপেটা জ্ঞান নিয়ে শ্যামনগর এর বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস নিয়ে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছি। গর্বের ভাষণটকে হটাৎ মাঝপথে থামিয়ে দিল আমাদের পাড়ারই এক বয়োজ্যেষ্ঠ দাদা বাবানদা। সে হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলো যে আচ্ছা তখন থেকে তো খুব বড়াই করে যাচ্ছিস ,যদিও মন্দ লাগছে তা বলছি না,  তবে বলতো দেখি আমাদের এই মাটিতেই জন্মানো এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে শিক্ষক, প্রশাসনিক আধিকারিক (সিভিল সার্ভেন্ট) তথা একজন সুসাহিত্যিক ছিলেন। জিরাফের মুষিকে পরিণত হওয়ার অবস্থা হল আমার।আমি বলেই ফেললাম যে ঠাট্টা করছো আমার সাথে? কিন্তু হ্যাঁ ঠিক সেদিনই প্রথম জানতে পারি ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় এর কথা।যিনি একদা এই শ্যামনগর এর অন্তর্গত রহুতার বাসিন্দা  ছিলেন।কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বহু মানুষই এই মানুষটার নাম জানেন না বা কচিৎ দুয়েকজন ছাড়া আর তেমন কেউই চেনেন না।

সেই সন্ধ্যায় প্রথম বাবাণদার থেকে বেশ কিছু জিনিস জানতে পেরেছিলাম ওনার সম্মন্ধে। ছোটবেলা থেকেই এই মানুষটি নাকি ভীষন উদ্ভাবনাময়ী ছিলেন। ছোটবেলাতেই নাকি আপনা থেকেই নানান ভাষার উদ্ভব করে তা সম্পূর্ণ নতুনরূপে বর্ণমালার আবিষ্কার করেন।সবচেয়ে অবাক করার বিষয় মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি সেসব সংযোজিত করে রাখতেন। ঘটনাচক্রে পরে এমনও শোনা গেছে যে তার সেসব বর্ণমালা পিটসম্যান এর লেখার সাথে অনেক সাদৃশ্যও পাওয়া গিয়েছিলো। এতদিন পর্যন্ত জানতাম বাবাণদা যথেষ্ট পড়াশুনা করা পাবলিক তবে তার টের সেদিনই পেয়েছিলাম। সত্যিই জীবনের গোটা ২৬ বছর পেরোনোর পরও কারোর মুখ থেকে একবারের জন্য এই নামটাই শুনিনি, সেদিনে প্রথমবার শুনছিলাম। পরে অবশ্য আমাদের এখানকার লাইব্রেরীতে খোঁজ নিয়েও তাঁর ব্যাপারে তেমন কোনো কিছু জানতে পারিনি বা তার লেখা কোনো বইও বিশেষ সংগ্রহ করা ছিল না যতদূর আমার জানা আছে। যাইহোক,শুনলাম তার ছেলেবেলার স্কুল এখানেই গ্রামের এক পাঠশালায় কেটেছে পরে অবশ্য তা বন্ধ হওয়ায় হুগলি নদীর ওপরে তেলেনিপারায় সংলগ্ন ডাফ সাহেবের স্কুলে ভর্তি হন। ছেলেবেলা থেকেই বহু দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে হার না মানা এই মানুষটি প্রথম বীরভূমের দ্বারকা নামক এক জায়গায় একটি স্কুলে ক্রমরত ছিলেন, এবং পরে সেখান থেকে ১৮টাকা বেতনের অন্য আরেকটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দারিদ্রের সাথে বড়ো হয়ে ওঠার এবং জীবনের নানা সময়ে নানাম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে তিনি তৎকালীন বাংলার পল্লিসমাজের দুর্দশা সচক্ষে দেখেন, মনে মনে ঠিক করে নেন যে এই সামাজিক দুরাবস্থার একটা চিরস্থায়ী সমাধান করা দরকার।

একটা সময় তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে একটি পত্র পান যাতে বলা ছিল যে তিনি যাতে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং তা করেওছিলেন ২৫টাকার বেতনের বিনিময়ে। সিরাজগঞ্জে থাকাকালীন তিনি নীলদর্পণ নাটকের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ও ডক্টর হবিশ্চন্দ্র এর সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। উড়িষ্যায় দারোগা থাকাকালীন খুব সম্ভবত ওড়িয়া ভাষায় তাঁর প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘উৎকল্ শুভকবি’ সম্পাদন করেন। ঠিক এইসময় তিনি প্রথম উইলিয়াম হান্টারের সংস্পর্শে আসেন এবং তার সহচর্যে কলকাতায় একটি কেরানীর চাকরিতে নিযুক্ত হন। উইলিয়াম হান্টার তিনি এক জায়গায় বলেছেন যে ‘ তাহার তুল্য দয়াবান ভদ্রলোক আমি দেখি নাই। বিদেশে থাকিয়া তা সত্ত্বেও তিনি ভারতের দিন দরিদ্রের মঙ্গলের জন্য নিমিত্ত যত্ন করিতেছেন। এই দুর্ভিক্ষের সময়ও তিনি ইংরেজদের নিকট হইতে টাকা আদায় করার জন্য তেজস্বীবাক্যে তিনি সমগ্র ইংল্যান্ড কম্পিত করিয়া তুলিয়াছে’।এতোটা শোনার পর আমি বাবনদাকে বলেছিলাম যে তুমি এতসব খোঁজ পেলে কিভাবে? হ্যাঁ হয়তো একটু বেশিই বোকামি ছিল প্রশ্নটায় তবে বাবানদা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই বলেছিল ‘পড়তে হয় নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়’। বেশি গভীরে আর না গিয়ে আমি সেবারে শুনেছিলাম এই মানুষটার সব কৃতিত্বের কথা বলা হয় ১৮৭৭-৭৮ সালে উত্তর পশ্চিম ভারতে দুর্ভিক্ষের সময় সেখানকার মানুষদের জীবনরক্ষার্থে প্রথম গাজর এর চাষ শুরু করেন। শুধু তাই নয় এর পাশাপাশি আরও তিনি সেইসব এলাকায় যাতে ভবিষ্যতে শিল্প গড়ে তোলা যায় তার একটি পথচিত্রও তৈরি করেছিলেন। তার এই কৃতকার্যে ইংরেজ সরকার আপ্লুত হয়ে ১৮৮১ সালে তাকে ভারত সরকারের রাজস্ব বিভাগে কাজ করবার সুযোগ করে দেন। এমনও শোনা যায় তারই অদম্য ইচ্ছায় ও জেদের যুক্তপ্রয়াশে ভারতীয়দের তৈরি সমস্ত জিনিস সমগ্র ইউরোপে তথা আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর ১৮৮২ সালে আমস্টারডামের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আদলে কলকাতায় ১৮৮৩ সালে তিনি একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন যার মূল ভিত্তিই ছিল ভারতীয়দের তৈরী পণ্য এবং তিনি সেই প্রদর্শনীর বিচারকের আসন লাভ করেন।

 বোধহয় অন্য কোন মানুষ হলে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন কিন্তু না এই মানুষটি হননি ১৮৮৬ সালে কলকাতা মিউজিয়াম এ সহকারী কিউরেটর পদে থাকাকালীন তিনি তার বিখ্যাত বই ‘ The Art Of Manufactures of India’ লেখেন যা সারাবিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়। তার লেখা এই বইটি বিশেষভাবে গ্লাসগো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল থেকে প্রথমবারের জন্য সংকলিত হয়। ১৮৮৭-৮৮ নাগাদ বাংলার কাঁচশিল্প ও মৃৎশিল্প এর পাশাপাশি তামা ও ব্রাসের ওপর লেখা মনোগ্রাফ দুটিই আজও অবিস্মরণীয়।

এতোটা শোনার পর নিজেকে শ্যামনগর এর পুরাতন বাসিন্দা বলতে সত্যিই একটু বাধোবাধোই ঠেকছিল।

সাহিত্যর আসনেও ইনি একইরকমের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন যদিও শুরুর দিকে অধিকাংশই তার সাপ্তাহিক ‘বঙ্গবাসী ও জন্মভূমি’  এই দুই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এক অদ্ভুত ধরনের কাজের জন্যে বাংলা সাহিত্য এই ব্যক্তিত্বকে মনে রেখেছে আজও। তার লেখা কঙ্কাবতী উপন্যাস প্রসঙ্গে কবিগুরু সেইসময় বলেছিলেন যে ‘এইরূপ অদ্ভূত একটা রূপকথা ভালো করে লেখাটিও বিশেষ ক্ষমতার কাজ এ এমন একটা কাজ যা এ দেশের বালক বালিকা ও তাদের মাতা পিতার মনোরঞ্জন করতে পারবে’।

পরবর্তীতে তিনি তাঁর জন্মস্থানে ফিরে এসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি তবে হ্যাঁ এটুকু বলতে পারি যে আজও বহু প্রতিভাবান মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া এমন একজন মানুষ হলেন এই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, যিনি একসময়ে বলেছিলেন যে ‘দরিদ্র মানুষের কাছে দেশ বলতে তাদের পেটের ক্ষুধা আর তার মঙ্গলকামনা বলতে দুবেলা দুমুঠো ভাত, আর যারা এই পরিস্থিতির মধ্যে নেই তারা আখের গোছাতে ব্যস্ত। তাদের কাছে সময়ই কোথায় নিঃসার্থভাবে দেশ সেবা করবার’?

খুব কম বাঙালিই আছেন যারা হয়তো বাংলা ভাষায় প্রথম বিশ্বকোষ (encyclopedia) তৈরি করা ব্যক্তিটিকে মনে রেখেছেন। যদিও পরে সেইকাজটি সম্পূর্ণ করেন অন্য আরেকজন।

এতগুলো কথা মন দিয়ে শোনার পরে অবশ্যই আমি বারবার নানা মানুষের সাথে কথা বলেছি এ বিষয়ে, কেউ বলেছেন শুনেছি শুনেছি মনে হচ্ছে আবার কেউ কেউ শোনেনি। কিন্তু এত কিছু পরও তিনি আছেন তার সৃষ্টির ও কৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামে হয়তো বিপ্লবীদের মতন আত্মবলিদান দেননি বলে ইতিহাস তাকে তার পাতায় জায়গা দিতে কিছুটা কঞ্জুশই করেছে তবে সেইসময়কার মানুষের দুর্দশা ঘোচাতে তিনি যে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন এবং নিঃসন্দেহে নিরলসভাবে যে প্রচেষ্টা তিনি করে গিয়েছিলেন এটাই বা বিপ্লবের থেকে কম কী।তবে হ্যাঁ যে কথাটা আমায় বারবার তাড়া করে বেরিয়েছে তা হলো কেনোই বা এইরকম একজন বাঙালিকে ইতিহাস খানিকটা অবহেলারচ্ছলেই রেখেদিল, কেনোই বা এই ব্যক্তিতটি আজও বাঙালির মনের মণিকোঠায় স্থান অর্জন করে নিতে পারেননি তেমনভাবে সর্বোপরি কেনই বা বাঙালি এমন একজন মানুষকে কিছুটা আলোবহির্ভূতই করে রেখে দিল। জানিনা আদৌ থাকাটা উচিত না অনুচিত তবে যান্ত্রিকতার যুগে সত্যিই বোধহয় আমরা একটু বেশীই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছি তাই না?

‘ভুলে যাওয়া বাঙালি’ এই শিরোণামে প্রতি বুধবার ও রবিবার আমাদের ওয়েবসাইট www.saptarshinag.in এ প্রকাশিত হবে একটি করে অধ্যায় | আর সেই লেখা হবে তোমাদের | বাংলার এমন কৃতি সন্তানরা যাঁদের আজ মানুষ ভুলে গেছে তাঁদের নিয়ে গবেষনামূলক লেখার সিরিজ এটি | লিখতে হবে বাংলায় | সেরা লেখাগুলো স্থান পেতে পারে kindle এ প্রকাশিত বইয়ে | তাই চটপট পাঠিয়ে দাও নিজের লেখা nagsaptarshi@gmail.com এই মেইল আইডি তে | ওয়ার্ড ফাইল এ শুধুমাত্র পাঠানো যাবে লেখা | লেখার গুণমান বিচার করে শুধুমাত্র ভালো লেখাই কিন্তু প্রকাশ পাবে | শব্দের কোনো সীমারেখা নেই | লেখা পাঠানোর ও ডেডলাইন নেই | এই সিরিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও তোমাদের |

News Reporter

2 thoughts on “ভুলে যাওয়া বাঙালি- পর্ব ২- ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়

  1. University porar subade”Konkaboti” upponash er hat dhore “Trailokyanath Mukhopadhay ” mohasoi er sathe khanikta chena jana hoi . Ajj eii ” Bhule Jao Bangali , porbo -2″ e Onar somporke bisesh bisesh totthadi jante pere khub e vlo lagche . Ebhaibei aro lekhar opekkhai achi .

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *