কলমে – Tinku Manna, টিঙ্কু মান্না
বেশ সুন্দর শান্ত পরিবেশ ,পড়ানোর শিক্ষক মহাশয়ের আগমনের বিলম্বের জন্য বন্ধু – বান্ধবীদের মধ্যে মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গার নানান গল্প বেশ জমে উঠেছিল – যেহেতু সময়টি পূজোর । যদিও আমরা ইচ্ছা করেই পূজোর সময়ে আমাদের শিক্ষক মহাশয়ের নিকট পড়ানোর জন্য অনুগ্ৰহ প্রকাশ করেছিলাম , কারন একই খরচে দেবী দুর্গার দর্শনের সাথে পড়াটাও হয়ে যাওয়া আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দের জন্য এটি একটি সুযোগ ছিল ।
আমাদের গল্প শেষ হওয়ার পূর্বে, আমাদের শিক্ষক মহাশয় হাসিবুর রহমান বাবুর আগমন ঘটে । হাসিবুর বাবু আমাদের গল্পে যোগ দিয়ে বললেন – ” মহিষাসুর মর্দিনী, অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবী দুর্গার সাথে সাথে ব্রিটিশদের মতো অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবী দুর্গার স্বরূপ বাঙালি মহিলাদের সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানো তোমরা ” ? আমাদের কিছু বলার পূর্বেই তিনি আমাদের দিকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললেন – ” বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দীর নাম তোমরা নিশ্চয়ই জানো ” ?
সত্যি বলতে কি , ইতিহাসের ছাত্র- ছাত্রী হয়ে আমাদের একথা বলতে খারাপ লাগছিল যে আমরা উত্তর টা ঠিকঠাক জানিনা । বাঙালি হয়ে অন্যতম মহান বাঙালির নাম না জানা আমাদের মতো বাঙালিদের কে দেখে শিক্ষক মহাশয়, হাসিবুর বাবু একটু হতবাক হয়ে গেলেন I
হাসিবুর বাবু শান্ত ভাবে মৃদু স্বরে বললেন – ” বাঙালি প্রথম মহিলা রাজবন্দী , অগ্নিকন্যার নাম ননীবালা দেবী ” । ননীবালা দেবী সম্পর্কে আমাদের জানার প্রবল আগ্রহ দেখে শিক্ষক মহাশয় একটু মুচকি হেসে বললেন , ননীবালা দেবী ১৮৮৮ সালে হাওড়ার , বালির এক মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্ৰহন করেছিলেন । তাঁর পিতা ছিলেন সূর্যকান্ত বন্দোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন গিরিবালা দেবী ।
সমকালীন সামাজিক রীতি মেনে ১৮৯৯ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে হলেও , ১৯০৪ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে ননীবালা দেবী বিধবা হন । বাল্য -বিধবা ননীবালা দেবী পিতার গৃহে ফিরে এসে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজের নানান বাধার সম্মুখীন হয়ে নিজের ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ।
গল্প বেশ জমে উঠেছে , সকলে মনোযোগ সহকারে শিক্ষক মহাশয়ের গল্প শুনছিলাম ,আমি প্রবল আগ্রহ দেখিয়ে তারপর কী হয়েছিল ? জিঙ্গাসা করায় , হাসিবুর বাবু চশমাটিকে টেবিলের উপরে রেখে বললেন -” চারীদিকে তখন দেশপ্রেমিদের উপর ব্রিটিশদের পৈশাচিক অত্যাচার চলছে ” । সেই অত্যাচারের ধরন ছিল, ফাঁসি , দ্বীপান্তর, পুলিশের নির্যাতনে পাগল হয়ে যাওয়া এবং দালান্দা হাউসে নিয়ে গিয়ে চালর্স টেগার্টের তদারকের মতো বিভৎস নিপীড়ন ।
হাসিবুর বাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন -১৯১৪ সালে ‘ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ‘ শুরু হলে যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ভারতব্যাপী স্বাধীনতা আনবার রাস্তা পরিষ্কার করতে প্রয়াস চালায় , এবং বীর যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি ‘ বালেশ্বরের খন্ড যুদ্ধে আত্ম ত্যাগ করে জাতিকে দেশের জন্য মরতে শিখিয়ে যান।
শিক্ষক মহাশয় বললেন এমন বিপদ সংকুল পরিস্থীতিতে বাড়ি- ঘর ছেড়ে ননীবালা দেবী ‘অড়িয়াদহ মিশনে ‘ আশ্রয় নিয়ে বিপ্লবী ভ্রাতুষ্পুত্র অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কাছে বিপ্লবী আন্দোলন ও যুগান্তর দলের কার্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে ছিলেন । তিনি বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদার এর স্ত্রী সেজে ‘প্রেসিডেন্সি জেল ‘ থেকে লুকিয়ে রাখা গুপ্ত পিস্তলের খবর নিয়ে এসেছিলেন । তিনি পলাতক বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চন্দন নগর শহরে গৃহকর্ত্রীর ছদ্মবেশ নিয়ে ঝুঁকি পুর্ন কাজ গুলিকে নিপুণ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছিলেন I
পড়ার ঘরের সকল ছাত্র- ছাত্রী নিরব হয়ে গেল । হাসিবুর বাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন , পুলিশ ননীবালা দেবীকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে অন্যান্য পলাতক বিপ্লবীরা কোথায় আছে তা জানতে চাইলে তার উত্তর না বলার জন্য ননীবালা দেবীকে লঙ্কা বাটার অসহ্য , অসম্ভব , অসহনীয় জ্বালা সহন করতে হয়েছিল – এই ভারত মাতাকে ব্রিটিশদের দ্বারা আবৃত পরাধীনতার অন্ধকারের গহ্বর থেকে স্বাধীনতার মুক্ত আলোকে আলোকিত করার জন্য ।
হাসিবুর বাবু একটু বেদনা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন -” তোমরা এখন পূজোর ব্রত করো নিজেদের ভালোর জন্য , কিন্তু এই মহান নারী একুশ দিন ধরে অনশন করেছিল সমগ্ৰ ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য ” । তাঁর এই অনশনের কারনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নড়ে- চড়ে বসেছিল এবং ১৯১৮ সালে ৩ নং রেগুলেশন এ ‘স্টেট প্রিজনার ‘ হিসাবে আটক করে রেখেছিল ননীবালা দেবীকে । তিনিই প্রথম বাঙালি মহিলা ‘ স্টেট প্রিজনার ‘ এবং প্রথম বাঙালি ‘ রাজবন্দী ‘ । ১৯১৯ সালে ননীবালা দেবী জেল থেকে মুক্তি পেলেও তৎকালীন পরিস্থিতির জন্য অসহায় ও নির্বন্ধি অবস্থায় তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল ।
ননীবালা দেবীর একটি বানী খুবই মর্মস্পর্শী — তিনি বলেছিলেন – ” স্বজনদের অনাদর লাঞ্ছনা এবং দারিদ্র্যের মধ্যে ও পরিপূর্ণ গৌরবে স্থির হয়ে জীবন কাটাতে হবে ” । ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৬৭ সালে মে মাসে তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন ।
হাসিবুর বাবু বাঙালির প্রতি ধীক্ষার জানিয়ে প্রতিবাদ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন , “স্বাধীনতার সুখ ভোগ করা আমাদের মতো বাঙালিরা বর্তমানে পৌরাণিক কাহিনীর অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবী দুর্গার কথা মনে রাখলেও বাস্তবে এই ভারতকে ব্রিটিশদের অন্যায়ের অন্ধকার গহ্বর থেকে স্বাধীনতার মুক্ত আলোকে আলোকিত করার জন্য ব্রিটিশদের মতো অশুভ শক্তির বিনাশকারী দেবী দুর্গা স্বরূপ বাঙালি নারীদেরকে বিস্মৃতির অন্তরালে নিমজ্জিত রেখেছি ” । আমরা বাঙালি হয়ে ননীবালা দেবীর মতো মহান ব্যক্তির জন্ম দিন ও মৃত্যু দিনের তারিখ মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনা । তিনি আজ স্বাধীনতা ভোগ করা বাঙালির কাছে উপেক্ষিত ।
পড়ার ঘরের সকলে নিরব হয়ে গেল , হাসিবুর বাবুর মুখে ননীবালা দেবীর মতো মহান বাঙালি নারীর জীবনের গল্প শুনে , ননীবালা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে যায় ও দুটি নয়নে অশ্রু ঝরতে থাকে ।
এমন সময় পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে প্রকৃতির শান্ত বাতাসের আগমনে আমাদের নিরাবতার ভঙ্গ হল , শিক্ষক মহাশয় পড়া লেখাতে শুরু করলেন , পড়ার ঘরের পাশের দূর্গা পূজার মন্ডপ থেকে মাইকে মন্ত্রপাঠ শোনা যেতে থাকলো এবং আমরা পড়ার দিকে মনোনিবেশ করলাম ।
‘ভুলে যাওয়া বাঙালি’ এই শিরোণামে প্রতি বুধবার ও রবিবার আমাদের ওয়েবসাইট www.saptarshinag.in এ প্রকাশিত হবে একটি করে অধ্যায় | আর সেই লেখা হবে তোমাদের | বাংলার এমন কৃতি সন্তানরা যাঁদের আজ মানুষ ভুলে গেছে তাঁদের নিয়ে গবেষনামূলক লেখার সিরিজ এটি | লিখতে হবে বাংলায় | সেরা লেখাগুলো স্থান পেতে পারে kindle এ প্রকাশিত বইয়ে | তাই চটপট পাঠিয়ে দাও নিজের লেখা nagsaptarshi@gmail.com এই মেইল আইডি তে | ওয়ার্ড ফাইল এ শুধুমাত্র পাঠানো যাবে লেখা | লেখার গুণমান বিচার করে শুধুমাত্র ভালো লেখাই কিন্তু প্রকাশ পাবে | শব্দের কোনো সীমারেখা নেই | লেখা পাঠানোর ও ডেডলাইন নেই | এই সিরিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও তোমাদের |
সিরিজের বাকি দুই পর্ব নিচে পাবে