কলমে : শিবম নন্দী
“হারিয়ে যাওয়া বাঙালিকে যদি বাঙালির মাঝে খুঁজতে যান,তবে দেখবেন বাঙালি জাতটাই আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।”
যারই মাঝে সব থেকে বেশি সৃষ্টি হয়েছে,তারই মাঝে সবথেকে বেশি ধ্বংস হয়েছে। তাই বাঙালির হাত ধরেই আজ বাঙালির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। আজ যার কথা বলবো তিনি হলেন, কবি জীবনানন্দ দাশ।
নামটা শোনার পর আপনার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে! “জীবনানন্দ দাশ ভুলে যাওয়া বাঙালি? ছ্যাবলামি হচ্ছে!” আমার উত্তর “হ্যাঁ” প্রমাণের হদিশ আপনি করুন। পথ এবং সূত্র আমি দেখাচ্ছি।
সময়টা একাদশের মাঝামাঝি, মধুসূদন এর একটি কবিতা পড়াতে পড়াতে আমার বাংলার মাস্টারমশাই সন্দীপবাবু আমাদের বললেন,- কবিতা তো অনেকেই লেখেন কিন্তু আমার মতে আমি যে তিনজন মানুষকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি তারা হলেন, জীবনানন্দ দাশ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনটি নাম শোনার পর খুব অবাক হয়েছিলাম, জীবনানন্দ দাশ! আসলে বাঙালির কাছে কবি কিংবা সাহিত্যিক লেখক কিংবা নাট্যকার ডানদিক কিংবা বামদিক একটাই নাম, রবীন্দ্রনাথ। হাসি পেলেও এটাই সত্যি, আপনিও জানেন। একের পর এক দিন, জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে অল্প অল্প করে জানা। স্যারের সঙ্গে আলোচনায় জীবনানন্দ দাশ,আর বাঙালি কে ক্রমাগত শব্দঘাত,যা বজ্রাঘাতের থেকেও শক্তিশালী।
স্যার বলতেন আমরা শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন,এই জীবনানন্দ লোকটিকে যদি ঠিকমত প্রকাশ করা যেত তবে না জানি কতগুলো নোবেল উপহার দিলে ওনার মূল্যায়ন করা যেত। প্রকৃতির কবি বলে চালানো এই জীবনানন্দ দাশ যে কতোটা রোমান্টিক ছিলেন তা বলাই বাহুল্য! কিন্তু বোঝে কে? বাঙালি? কটা?
স্যার বরাবরই বলেন,-জীবনানন্দ দাশ লোকটি সবার জন্য নয়। খুব বিস্মিত হতাম। খুব অবাক হতাম যখন বলতেন,- জীবনানন্দ দাশ প্রতি মুহূর্তে তার লেখার মাধ্যমে ধর্ষিত হচ্ছেন। শব্দটা কানে বাঁধলেও স্যারের মাধ্যমে যখন একটা,দুটো কথা.. লেখা লেখির মাধ্যমে জীবনানন্দ লোকটিকে যখন উপলব্ধি করছি এবং তার ভিত্তিতে বিচার করছি তখন সত্যি অবাক হচ্ছি জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে ভুল বোঝার যে প্রবণতা যা জাগ্রত হচ্ছে সমাজের কিছু মানুষের মধ্যে ,তাতে তার কবিতাগুলোকে খুব নিশংস ভাবে নিগ্রহ করা হচ্ছে যা সত্যিই লজ্জা জনক।স্যার মজা করে বলেন,”হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি।” এই হাজার বছর যে মানুষ বাঁচে না সেই অজুহাতে বাঙালি জীবনানন্দ কে তারকাটা বানিয়ে দিয়েছে। চির আধুনিক ঠোঁট কাটা সন্দীপ দে-র থেকে অনেক কিছু জেনেছি, যখন পড়ালেন জীবনানন্দের ‘শিকার’। বললেন এই কবিতাটা তোদের পাঠের উপযুক্তই নয়। আমরা বললাম,- কেনো? উনি বললেন এই কবিতাটার প্রকৃত অর্থ যা, তা নাকি তাবড় তাবড় ডিগ্রি ধারি দের কাছেও অসাধ্য। মানে মগজে প্রবেশ করানোর পড় এদিক ওদিকের বই ঘেটে বুঝলাম। কথাটা সত্যি কতটা দামি।
যিনি এখনও হয়তো বসে ভাবছেন, জীবনানন্দ দাশ হারিয়ে যাওয়া বাঙালি তালিকায় পড়ে কিনা! তাকে প্রশ্ন করি জীবনানন্দ দাশ তার জীবৎকালে কটি পুরস্কার,সম্মান পেয়েছেন? ওমা ভাবতে হচ্ছে কেনো? নির্জনের কবি জীবনানন্দ দাশ, নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু বাঙালি কি সেই রত্নকে খুঁজতে চেষ্টা করেছে? আজও কি করে! ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, তবুও লোকটি আমৃত্যু কোনো স্থায়ী চাকুরী সুখ ভোগ করতে পারে নি। অথচ বাংলা সাহিত্যের এক ধারা উন্মোচন করে দিয়ে গেছেন রূপসী বাংলার কবি। আজীবন ‘প্রকৃতির কবি’ শব্দের বাইরে গিয়েও ভাবতে শিখিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে প্রকৃতির দুয়ারে কড়া নেড়ে প্রকৃতির হাত ধরেই এই সংসারের অন্যান্য বিষয় গুলোকে স্পর্শ করতে হয়। কবিতায় আধুনিকতার জন্ম দিয়েছেন। রবীন্দ্রত্তর যুগে,নজরুলের প্রায় সম বয়সী, রবীন্দ্রনাথের প্রসংশা ধন্য জীবনানন্দ বিদ্রোহী কবির ছিটেফোটাও জনপ্রিয়তা,সম্মান পান নি সেই সময়ে। উপরন্তু তার কাব্য নিয়ে পেয়েছেন এক গুচ্ছ নিন্দা। তৎকালীন সময়ে সজনীকান্ত দাস কবি প্রসঙ্গে অশালীন ভাষায় ভৎসনা করতে শুরু করেন, তার প্রতি অশ্লীলতার অভিযোগে। যদিও এই অশ্লীলতা বিষয় টা নিয়ে আমার মনে এক বিপুল সংশয়, তথাকথিত বাঙালির কাছে যৌনতা অশ্লীলতার তালিকায় পড়ে। আর রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গরিব রিকশাচালকের গালে থাপ্পড় মারা টা ভীষণ শ্লীল। সেই সময় শোনা যায় কবির কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে তার চাকুরী থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোল যুগ’ (১৯৫০) গ্রন্থটিতে জীবনানন্দ এবং সিটি কলেজ সম্পর্কে লেখেন, ‘সিটি কলেজে লেকচারারের কাজ করত জীবনানন্দ। কবিতায় শস্যশীর্ষে স্তনশ্যামমুখ কল্পনা করেছিল বলে শুনেছি সে কর্তৃপক্ষর কোপে পড়ে। অশ্লীলতার অপবাদে তার চাকরিটি কেড়ে নেয়। যতদূর দেখতে পাই অশ্লীলতার হাড়িকাঠে জীবনানন্দই প্রথম বলি।’ বইটি প্রকাশের আগে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময় জীবনানন্দ তাঁর সম্পর্কে অন্য তথ্য সংশোধন করে দিলেও চাকরি যাওয়ার কারণ নিয়ে অচিন্ত্যকুমারের বক্তব্য বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।
জীবনানন্দের সমসাময়িক কবিগণ নানা ভাবে যেখানে কবিপ্রত্যয়কে খুঁজে পেয়েছিলেন, সেখানে তাঁর কবিসত্তায় কোনরূপ প্রত্যয়হীন নীলকণ্ঠ প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সমালোচক। সে দিক থেকে যুগের অস্থিরতায় বিমূঢ়তার অবকাশ থাকলেও কবিমানবের বিভ্রান্তির পরিচয় নিয়ে বিতর্ক বর্তমান। জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি নিয়ে আজও না জানি কত পাঠকের মন-দুয়ারে বিতর্ক ডানা বাঁধছে। যারা এখনো ভাবছেন আদতেই নামটি কি হারিয়ে যাওয়া বাঙালির তালিকায় পড়ে? তাদের বলি, আপনি নিজেই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন সমাজের দিকে কটা মানুষ এই লোকটিকে ঠিকমতো চেনেন! এই চেনার মাঝেই হয়তো লুকিয়ে আছে গুটি কয় শব্দ,’রূপসী বাংলার কবি’,’বনলতা সেন’,’প্রকৃতির কবি’ ইত্যাদি। আর কি? কিন্তু এতেই কি শেষ!
নামের অর্থের উল্টো পথে বাধ্য হয়ে হাঁটা জীবনানন্দ শেষ জীবনের মৃত্যু নিয়েও সংশয় একি আত্মহত্যা? নাকি নিছক দুর্ঘটনা?
____________________________
জীবনানন্দ সাহিত্যের এক বৃহত্তম অধ্যায় তাকে নিয়ে পড়াশুনা,গবেষণা, তাকে বোঝা সারা জীবনেও শেষ করে ওঠা সম্ভব কিনা জানিনা।
‘ভুলে যাওয়া বাঙালি’ এই শিরোণামে প্রতি বুধবার ও রবিবার আমাদের ওয়েবসাইট www.saptarshinag.in এ প্রকাশিত হবে একটি করে অধ্যায় | আর সেই লেখা হবে তোমাদের | বাংলার এমন কৃতি সন্তানরা যাঁদের আজ মানুষ ভুলে গেছে তাঁদের নিয়ে গবেষনামূলক লেখার সিরিজ এটি | লিখতে হবে বাংলায় | সেরা লেখাগুলো স্থান পেতে পারে kindle এ প্রকাশিত বইয়ে | তাই চটপট পাঠিয়ে দাও নিজের লেখা nagsaptarshi@gmail.com এই মেইল আইডি তে | ওয়ার্ড ফাইল এ শুধুমাত্র পাঠানো যাবে লেখা | লেখার গুণমান বিচার করে শুধুমাত্র ভালো লেখাই কিন্তু প্রকাশ পাবে | শব্দের কোনো সীমারেখা নেই | লেখা পাঠানোর ও ডেডলাইন নেই | এই সিরিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও তোমাদের |