সাহেবের ভবিষ্যৎ (গল্প )

লেখা – সপ্তর্ষি নাগ

সরকারি আপিসে বাবু তখনো ঢোকেননি। ইতিউতি গুটিকয়েক কর্মচারির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকজন এসেই কম্পিউটার খুলেই কমেন্ট করছেন পরিচিতের প্রোফাইলে। ছেলেটা সকাল দশটায় ঢুকে গেছে আপিসের চৌহদ্দিতে। কাজের ব্যাপারে জানাতেই জবাব মিললো ঘন্টাখানেক পরে আসতে হবে।
কিন্তু আমার যে খুব জরুরি কাজ।
বললাম তো একবার, বয়রা নাকি? পরে আসবে। যত্তসব!
বাইরে কাঠফাটা রোদ্দুর। ঘন্টাখানেক কোথায় ঘুরবে ছেলেটা? তার উপর আবার মাথায় একরাশ চিন্তা। আজকেই কাগজটা এই আপিসের অধিকারিককে দিয়ে সই করে সন্ধ্যায় ট্রেনে চাপতে হবে। কাল চাকরিতে জয়েনিং। সমস্ত কাগজ, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট সই করিয়ে নিতে হবে। এদিক ওদিকে ঘুরতে থাকল ছেলেটা।

ঘন্টাখানেক পর।
বাবু তখনো ঢোকেননি। আবার বাবুর আর্দালিকে ধরল ও।
ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর।
কাকু, একটু বলুন না স্যার কখন ঢুকবেন।
এত দরকার তখন এতদিন ঘুমোচ্ছিলে নাকি?
কাকু আমাকে চিনলেন না? আমি তো গত সাতদিন ধরে কয়েকটা সইয়ের জন্য ঘুরছি। আপনিই তো কতবার বলেছেন স্যার ব্যস্ত দেখা হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, সাহেব ঢুকুক, দেখছি।
সাহেবের দপ্তরের বাইরে লোকের ভিড় তখন । বসার জায়গা ও অপ্রতুল।
চিমসে গোছের কিছু লোক বাইরে ঘোরাফেরা করছে শকুনের চাউনিতে। যেন শিকার খুঁজছে। এক বাবা কোলে ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে আছে। আরেক হাতে একটা চটের ব্যাগ। পাশে স্ত্রী দাঁড়িয়ে ঘোমটা পরে। বাচ্চাটা তারস্বরে কাঁদছে।
তিনটে লোক ঘুরছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। একজনের গলায় ক্যামেরা। মনে হচ্ছে সাংবাদিক হবে। হয়তো সাহেবের বক্তব্য নেবে।
এক বৃদ্ধ আপিসের বাইরে বটগাছটার তলায় বসলেন। স্ত্রী অসুস্থ। হেলথ স্কিমের টাকা পাননি এখনো। সাহেব নাকি বলেছেন বিলে গন্ডগোল আছে। এই সত্তর বছর বয়সে বিলে কি যে গন্ডগোল এত তার যে কি সুরাহা তা সাহেবের কাছ থেকেই শুনবেন।
হঠাৎ কর্মীদের মধ্যে ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেল। ফিসফাস আওয়াজে বোঝা গেল সাহেব ঢুকছেন। দূর থেকে শোনা গেল হুটারের আওয়াজ। গাড়িতে বাতি জ্বলছে। কয়েকটা মেয়ে সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ি থেকে সাহেবের দেহরক্ষী কি যেন বলল রূঢ়ভাবে। ভয়ে ভয়ে রাস্তার পাশে দেয়ালে যেন সিঁটিয়ে গেল ওরা। সাহেব ঢুকছেন। রাস্তা কি আর ওদের?

দুই আর্দালি সবাইকে সরাতে থাকল।
রাস্তা ছাড়ুন, রাস্তা ছাড়ুন, সাহেব ঢুকছেন।
সবাই সরে দাঁড়াল।
গাড়িটা হ্যাঁচকা শব্দ করে দপ্তরের ঠিক সামনে দাঁড়াল। সাহেবকে যেন একটুও কষ্ট করতে না হয়। গাড়ি থামলেও সাহেব নামলেন না। দেহরক্ষী আগে নেমে দরজা খুলে স্যালুট ঠুকল। তারপর সাহেব নামলেন। চোখে রোদচশমা। বাইরের বিবর্ণ সমাজ চশমার ওপারে রংচঙে লাগে। বাইরের কর্মীরা নমস্কার ঠুকল। সাহেব কোনোদিকে না তাকিয়ে ঢুকে পড়লেন বিলাসবহুল চেম্বারে। কয়েক সেকেন্ড বাইরের গরম অসহ্য ঠেকছিল সাহেবের। কপালে ঘাম জমে গেছে যেন। কপালটা মুছে সটান ঢুকলেন ওয়াশরুমে। জেল দেওয়া চুলটা একটু ভিজিয়ে নিতে হবে।

বাইরের লোকজন তাড়াহুড়ো করে আবার জমা হল চেম্বারের বাইরে। আর্দালি কড়াভাবে বলল, আরে আগে ফর্ম ফিলাপ করুন। এখনো ভিসিটিং আওয়ার শুরু হয়নি।
সেই ছেলেটা আবার বলল, কাকু আমার যে খুব তাড়া।
ওসব দেখেছি অনেক।
বয়স্ক মানুষটা ভিড় সরিয়ে কাগজের ফর্ম নিলেন। দেয়ালের ওপর কাগজটা রেখে ভরতে লাগলেন ফর্ম। সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হবে যে। ভুল হলে চলবে না।
এক বেয়ারা ট্রে’তে সাজিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। দামি দার্জিলিং চায়ের সুবাসে চারিপাশ যেন ভরে উঠল।

আধা ঘন্টা পর।
সাহেবের বেল বাজল।
আরো অনেক লোক জমে গেছে। সবাই ভাবল নিজের নম্বর এল বুঝি।
এই যে সাংবাদিক সাহেবরা, আসুন। স্যার ডাকছেন।
এরই মধ্যে ছোটসাহেব, মেজসাহেব সবাই সাহেবের সঙ্গে দেখা করে গেছেন। সেজসাহেব আবার দেখা করতে একখান দামি কলম এনেছেন। দিনকয়েকের ছুটি লাগবে। সাহেবের মুড ঠিক রাখা দরকার।

দপ্তরের কর্মীরা ফাইল নিয়ে ঢুকছেন। কেউ কেউ আবার ঢোকার আগে মোবাইলে নিজের ছবি নিয়ে দেখে নিল। সকাল থেকে কাজ চলছে তো। শরীরে ক্লান্তির ছাপ না থাকলে সাহেব কি ভাববেন!

দুটো বাজতে চলল। সাংবাদিকরা বেরোল। সাহেব আর্দালিকে ডেকে কিছু বললেন। সে এসে ঘোষণা করল, সাহেব এখন লাঞ্চে যাবেন। তারপর উদ্বোধন আছে একটা। চারটের আগে দেখা হবে না।
ছেলেটা এসে কিছু বলতে যাচ্ছিল। এবার দেহরক্ষী কড়া ধমক দিল। ছেলেটার চোখে জল চিকচিক করছে। কার কাছে যাবে ও? কে শুনবে ওর কথা?
বয়স্ক মানুষটা নিরাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। তিনটে ঘন্টা নষ্ট হল।
বাচ্চাটা তখন আবার ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কান্না ধরল । বাচ্চার বাবা খেল ধমক, সাহেব বেরোনোর আগেই এখান থেকে বেরোন। সাহেব কোথাও বেরোনোর আগে কান্না পছন্দ করেন না।
সাহেব বের হলেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে গাড়ি হুস করে বেরিয়ে গেল।

বিকেলের দিকে বেশি লোক থাকে না দেখা করতে। একজন বৃদ্ধ শুধু সেই সাহেবের বেরোনোর একটু পর থেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞাসা করাতে বললেন খুব জরুরি কাজ। মুখ বেঁকিয়ে জবাব পেলেন, ওসব কথা সবাই বলে। এই বুড়ো বয়সে আপনার আবার কি কাজ থাকবে?
বৃদ্ধ কিছু বললেন না। হাতে একখানা বিকট ধরণের ঘড়ি। মাঝে মাঝে সেটার ডায়ালখানা ঘোরাছিলেন।
পাঁচটা নাগাদ সাহেব ঢুকলেন। যথারীতি আগের মতোই চেম্বারে ঢুকে পড়লেন।
বয়স তো অনেক হল, সাহেব মানুষ ঢুকলে একটু সরে দাঁড়াতে হয় জানেন না, দেহরক্ষীর তির্যক কথা বৃদ্ধর দিকে।
বাবা, বয়স আমার আশির কাছে। হাঁটতেও পারি না গো ঠিকমতো। আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা, আকুতি বৃদ্ধের।
ফর্ম ফিলাপ করলেন তিনি। প্রায় আধা ঘন্টা পর ডাক এল।
দুমিনিটে কথা সারবেন। সাহেব ব্যস্ত খুব- সতর্ক করল আর্দালি।

চেম্বারে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে তারপর সাহেবকে দেখে বৃদ্ধের চোখে যেন জল চলে এল। জামার খুঁট দিয়ে জল মুছে বললেন, শুভস্মিত ভালো আছো?
সাহেব ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে।
দৃষ্টি বলে দিচ্ছে কি বলতে চাইছেন, কি করে আমার নাম ধরে ডাকার সাহস হয়?

চমকে গেছ তাই না, তোমাকে নাম ধরে ডাকলাম?
কি চান বলুন তো, ধমকের সুরে বললেন সাহেব।
নিজেকে এখনো চিনলে না হে শুভ। আমি তো তেমন কিছুই চাইনা, শুধু নিজের অতীতকে দেখতে চাচ্ছিলাম। দেখলাম আমি মানে তুমি তোমার নিজের অতীতকে খুব সহজেই ভুলে গেছ। ওই যে একটা ছেলে ঘুরছিল না সকালে তোমার সই করানোর জন্য ওটাও তুমি ই। তোমারই বিশ বছর আগের জীবনে। এই জীবনে তো সব ভুলে গেছ হে। তাই আবার ভবিষ্যতের তুমি হয়ে তোমাকে তোমার ভবিষ্যৎ দেখাতে এলাম। দেখলাম তুমি এত ব্যস্ত যে চল্লিশ বছর পরের নিজেকেও দেখতে তিন ঘন্টা সময় নিলে। আর কুড়ি বছর আগের নিজের সঙ্গে তো দেখা করারই সময় নেই তোমার। তৈরি হও হে ভবিষ্যতের জন্য।
বৃদ্ধ লোকটা হাতের ঘড়িটাতে কি খুটখাট করলেন। মুহূর্তে হাওয়া তিনি। মানে ভ্যানিশ! দরজাটা বন্ধই আছে।
চমকে গেলেন সাহেব। টাইম ট্রাভেল কি সত্যি?
বেল টিপলেন তিনি। আর্দালিকে নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কেউ আছে বাইরে?
বিহ্বলতা তখনো কাটেনি তার।

News Reporter

5 thoughts on “সাহেবের ভবিষ্যৎ (গল্প )

  1. Sir,
    Asadharon Hoyeche!!!

    Character er name er time machine er concept chara Ei Golper sob choritro bastob; DM/ BDO/ SDO office er samne tader dekha mele.

    1. Sir, it is the harsh reality, the bitter truth. It reminds me my recent experience. Though the work was not related to any ‘Big Saheb’, but with the experience is more or less the same. The red tape file culture still exist in our system. On 9th February, I went to our Municipal Corporation office on 10:30 am to enquire the mutation status of my residential property which I purchased in mid 2020. I was applied in offline in the BLRO on Aug, 2021 and in online on Sept 2022 (online application for mutation was not available before that). Till Feb’2024, there was no update. And I waited from 11am to 4:35pm in the office to submit my applicants to Asst Engg so that he can look after the thing.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *