শুভাশিস ঘোষ ,WBCS(Exe)
তখনো ক্লাস ওয়ানে উঠিনি। জলপাইগুড়ির বাইরে যাইনি। এমনকি জল্পেশ মেলাও না। চাবাগান দেখতেও না। দার্জিলিং না। হলদিবাড়ি হুজুরের মেলাও না।
হঠাৎ একদিন বাড়িতে হইচই উঠলো পরদিন কলকাতায় যাওয়া হবে। আমার প্রথম কলকাতা যাওয়া,এমনকি আমার মায়েরও!!!
আমি তখন শুধু জানতাম কলকাতা হলো আমাদের রাজ্যের capital, স্কুলে শিখিয়েছিলো সিস্টার ইনেস আমার প্রথম প্রিন্সিপাল , আর জানতাম কলকাতা থেকে ট্রেনে করে খবরের কাগজ আসে আর ওখানে ইডেন গার্ডেনস্ বলে একটা বাগানে খেলা হয় বড় বড় যার ছবি বের হয় কাগজের পেছনের পাতায়। আর সবচেয়ে সুন্দর দুজন মানুষ উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেন কলকাতাতে থাকে।
ট্রেনের রিজার্ভেশন ছাড়া সাধারণ কামরায় মেঝেতে চাদর পেতে বসে যাওয়া হয়েছিল। বাবার মাসি, খুকু দিদার বাড়িতে উঠেছিলাম পার্ক স্ট্রিটের কাছে। ট্রাম চড়েছিলাম, আর কি কি যেন দেখেছিলাম - তারামন্ডল, নেহেরু মিউজিয়ামে গিয়ে খেলনা গাড়ি চড়েছিলাম। কিন্তু তারও আগে আরেকটা কান্ড হয়েছিল। সে কান্ড বোঝাতে একটা সিনেমার গল্প বলি যা অনেক পরে দেখেছিলাম।
উৎপল দত্ত মশাই আর পালেকরের "গোলমাল", না না এখনকার ১,২,৩ নম্বরিগুলোর গোলমেলে ব্যাপারের সাথে এর কোন তুলনাই হয়না,এ একেবারেই গোল মাল, নিটোল যাকে বলে। সিনেমায় ইন্টারভিউ চলছে চাকরির, কোম্পানির মালিক ভবানীশংকরের চেম্বারে, খেলার "খ" জানলেই চাকরির আশা মরিচীকা হয়ে যাবে কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে খেলা নিয়েই-
- "ব্ল্যক পার্ল কে ওয়ারে মে কুছ বাতাইয়ে?"
- "মুঝে তো ইয়ে পতা নহি থা কে মোতি কালা ভী হোতা হ্যয়, ম্যয় তো ইয়েহি সমঝতা থা কে মোতি কেবল শ্বেতবর্ণ হি হোতা হ্যয়...."
ভবানীশংকর কড়া পরীক্ষক, ছাড়ার পাত্র নন, একটু খেলুড়ে হাসি গোঁফের নীচে এনে মাথা নেড়ে বললেন
- "ম্যয় পেলে কি বাত্ কর রহা হু।"
- "ওহ তো মহান আদমি হ্যয় স্যার বহতহি মহান..."
গম্ভীর হন ভবানীশংকর, ও ব্যাটা তুমি খেলা দেখো তাহলে...
- "জানতা হ্যয়.. তো উনকী মহানতা কে বাড়ে মে কুছ বাতাইয়ে? "
- "পার ক্যাপিটা ইনকাম অব্ দ্য ব্যাকওয়ার্ড ট্রাইবস অব্ মহারাষ্ট্র পর উনকা সোদ গ্রন্থ পড়নেহ ইয়োগ্য হ্যয় স্যার।"
আক্কেলগুড়ুম ভবানীশংকরের
- "কিসকি বাত কর রহে হ্যয় আপ?"
খানিক চড়া গলায় জিজ্ঞেস করেন।
রামপ্রসাদ দশরথপ্রসাদ শর্মা( ম্যয় হু না-র শাহরুখ খান না) অমল পলেকর, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না এভাবে বলে চলেন
- "রেলেহ্ স্যার, প্রফেসর রেলেহ্ প্রসিদ্ধিয়া অর্থশাস্ত্রী.."
- "নহি নহি ম্যয় পেলে কি বাত্ কর রহা হু, P-E-L-E পেলে the famous footballer player..."
- "হা কুছ দিন পহলে সমাচারপত্রমে পড়াহ্ অবশ্যিয়া থা কে কলকাত্তা মে তিশ চালিশ হাজার পাগল আধি রাত দমদম এয়ারপোর্ট পহুঁচ গয়ে থে উনকি দর্শন করনে..."
পাগলই বটে।
কত হাজার কি লাখ জানিনা তবে বাবার হাত ধরে আমিও ছিলাম পাগলদের দলে, কিছুই দেখিনি, খালি মানুষ আর মানুষ আর চিৎকার - "পেলে পেলে পেলে!!!"
আমার খুকু দিদার আকাশবাণী কলকাতাতে ভালো যোগাযোগ ছিলো কিন্তু তিনি অনেক চেষ্টা করেও ইডেনে খেলার টিকিট জোগাড় করতে পারেননি। তাই খেলা দেখা হয়নি। তবে এটাই স্মৃতি যে "পেলে দেখতে যাওয়া হয়েছিল কলকাতায়"।
তারপর থেকে বহু বছর আমাদের ছেলেবেলায় খেলার মাঠে লেবু লঞ্জেস বিক্রি হতো এটা হাঁক পেড়ে- "পেলে দশ পেলে দশ", কলকাতার ময়দানতো বটেই মফস্বলের মাঠেও এই আওয়াজ শোনা যেত খেলার মাঠে কান পাতলেই- "পেলে দশ পেলে দশ"।
পেলে কত বড় প্লেয়ার ছিলেন? পেলে কি সেরা ছিলেন? ধুর্ ওসব নিয়ে অন্যরা থাকুক।
আমি জানি আমার "লেভেল হেডেড" বাবা, মাসে তখন বোধহয় মাত্র শ'তিনেক টাকার বেতনে কোনমতে মাসের শেষদিকে মাঝে মাঝে ধার করে সংসার চালানো বাবা, আমাকে নিয়ে কোনদিন কোন নেতা অভিনেতা সাধু সজ্জনের দর্শন করতে না যাওয়া মা, এমনকি তার আগে কোনদিন কলকাতায় না যাওয়া মা আধদিনের নোটিশে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন পাঁচ বছরের ছেলেকে পেলেকে দেখাতে।
পেলে দশ পেলে দশ পেলে দশ - বাকিরা অনেক পরে...