সপ্তর্ষি নাগ
বেশ অনেকদিন আগের কথা। এয়ারপোর্টে ঢুকেছি। এমনিতেই এসব জায়গায় গেলে আমার বুকের ভেতর একটু দুরুদুরু করে। মনে হয় এই বোধ হয় আদব কায়দায় কোনো ভুল করে ফেল্লাম। এই বোধহয় গলায় নীলরঙের একটা মালা থুড়ি ফটো আই ডি না কিসব বলে পরা একটা স্মার্টগোছের ছোকরা এসে বিরক্তির সুরে বলবে, “This is not the way to do it, man”।
একদিকে এমন চাপা ভয়, আর আরেকদিকে পেয়েছে ভারী জলপিপাসা। একটা দোকানে জল কিনতে গেলে যা দাম শোনালো মনে হল আরেট্টু পরে ওই টাকাতে জল না বরং দুপুরের ভাত হয়ে যাবে। অগত্যা খুঁজছি জলের সন্ধান। এক দোকানে বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম ‘দাদা, ফ্রী তে জল কোথায় পাবো?’
ফ্রী শব্দ শুনে প্রথমেই এমন বিরক্তি তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠলো যেন আমি তার গিন্নির ফোন নম্বর চেয়েছি! তার উপর আবার বাংলায় বলেছি। নিজের রাজ্যের রাজধানীর বিমানবন্দর থুড়ি এয়ারপোর্টে ও বাংলা বলা যেন এক অমার্জনীয় অপরাধ। অবশেষে বিরক্তি, তাচ্ছিল্য, ক্ষমাঘেন্নার পাঁচমিশালী অভিব্যক্তি দিয়ে সে এক হাত দিয়ে সোজা গিয়ে বাঁয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। এদিকে জ্লপিপাসা তখন তুঙ্গে। আগের রাতের বিরিয়ানির ফল।
যাই হোক, ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে চললাম তৃষ্ণা নিবারণে। কিছুটা এগোতেই সত্যিই দেখলাম বাঁ দিকে Drinking Water সাইন জ্বলজ্বল করছে। জলের জ্বলজ্বলানির জ্বলন্ত উদাহরণ তখন আমার মতো তৃষ্ণার্ত আদবকায়দাহীন অভব্যের কাছে মরুভূমিতে মরুদ্যানসম। অবশেষে এক বিরাটাকার পিলারের পেছনে তাকে পেলাম। ছোট্ট একটা স্ট্যান্ডের উপর স্টিলের বেসিনে সে বসে আছে কি রাজকীয় ভঙ্গিমায়। জলপানের আনন্দে তখন কাগজের কাপ খুঁজছি। কিন্তু কোথায় ছাতা কাপ! আর স্ট্যান্ডের উচ্চতাও আমার কোমর সমান বা এট্টু বেশি হবে। তারপর সবক্ষেত্রেই যেটা করি আর কি! অপেক্ষা করছি আর কার আমার মতো ফ্রী তে জলপানের প্রয়োজন হয় তার জন্য। কি মুশকিল! কেউ তো আসছে না! তার মানে হয় এয়ারপোর্টের সবাই জল কিনে খায় কিম্বা দিনের ওই সময়টাতে এয়ারপোর্টে জল খাওয়া বারণ! ইতিউতি তাকিয়ে এরকম কোনো নোটিস চোখে পড়ে কিনা দেখছিলাম। ধরুন লেখা থাকবে ‘Drinking Water is Strictly Prohibited Within This Airport Premises From 1 PM to 1.30 PM’ এই গোছের এই কি! না, সেসব ও তো নেই। অথচ কেউ আসছেও না। অবশেষে বুদ্ধি এলো। ইউটিউব খুললাম। সার্চ করলাম ‘ How to drink water at the Airport?’। হাজারগন্ডা রেজাল্ট বেরোলো। সবচেয়ে কমসময়ের টা ক্লিক মারলাম। ভিডিওটা খুলতেই বেশ স্মার্ট এক যুবককে দেখালো। মুখচোখে যা জেল্লা দিচ্ছে একবার ভাবলাম, এও আমার মতো ফ্রি তে জল খায়? যাইহোক, চোস্ত ইংরেজিতে সে যা বললো তার মানে দাঁড়ালো – স্টেপ ওয়ান – প্রথমে বেসিনের একদমই কাছে চলে আসুন। আমি গেলাম। স্টেপ টু – বাঁ হাত দিয়ে বেসিনের নিচের কালো বোতাম টিপুন। যথা আজ্ঞা হুজুর। কিন্তু কোথায় কালো বোতাম। ভিডিও টা পউস করে তন্নতন্ন করে কালো বোতাম খুঁজছি হঠাৎ শুনি ‘ Excuse Me’। পেছনে ঘুড়ে দেখি একটা বছর বিশের ছেলে দাঁড়িয়ে। একটা চেক শার্ট, একখানা জিন্স, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, পায়ে চপ্পল আর কানে ইয়ারফোন। পুরো ‘কুল গাই ‘ ব্যাপার আর কি! আমরা নীল গাই শুনেছি, দুধেল গাই শুনেছি। কুল গাই দেখলেই কেমন ভয় ভয় করে। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝলাম ইয়ারফোনের ওপারের কোনোকিছু ওকে ইহজগৎ নিয়ে নির্লিপ্ত করে দিয়েছে। এমন সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাবো এই ধৃষ্টতা আমার আছে? আমি সরে যেতেই সে সেরকম নির্লিপ্ত ভাবেই বেসিন টার সামনে দাঁড়িয়ে পুরো অ্যাথলিটদের মতো শরীরটাকে বাঁদিকে ৪৫ ডিগ্রি বেঁকিয়ে, অনেকটা সেই ম্যাট্রিক্স সিনেমাটার মতো, মুখটাকে তাক করে ঠিক ট্যাপটার মুখে রাখতেই, সেই অমৃতধারা বেরিয়ে এল। এদিক ওদিক না একদম মুখে। সেদেখে আমিও শরীর বাঁকানোর একটু প্র্যাক্টিস শুরু করে দিলাম। এদিকে ওদিকে এট্টু দেখেও নিলাম। তেমন লোকজন নেই। কুল ছেলেটা সেই মহাজাগতিক দুনিয়াতে ফিরে গেল আবার।
এবার সাহস করে পুরো ছেলেটার কায়দায় শরীরটা বাঁকালাম। খট করে একটা শব্দ। কোনো একটা হাড় এই কিম্ভুত অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানালো। তাও আবার বাঁ দিকে বেঁকতে হল। মানে জলের জন্য আমি পন্থাও বদলে ফেল্লাম। কিয়ানু রিভস কে স্মরণ করতে করতে অবশেষে মুখটা কোমরসমান উচ্চতায় নিয়ে বাড়িয়ে দিলাম জলের কলটার দিকে। হাড়গুলোর পরিত্রাহী চিৎকার রীতিমতো শুনতে পারছি। কিন্তু অবশেষে সে আমার মুখে এলো। আহ, পবিত্র, স্বচ্ছ জলধারা। শরীরের কষ্ট খানিকটা হলেও ভুলিয়ে দিল জীবনদায়ী শীতলতা। বেশ তৃপ্তির সঙ্গে শরীরকে আবার অর্ধবক্রসর্পচক্রাসন থেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফেরাতে গেলেই বুঝলাম যে কষ্ট আজ দিলাম, এই ব্যাথা সহজে যাওয়ার নয়।
আমার একটা বন্ধুর কথা মনে পড়লো। সে ব্যাটা ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার। একদম নির্মেদ, ছিপছিপে চেহারা। নিজের বাড়ন্ত মধ্যপ্রদেশের কথা ভেবে ওর চাবুক শরীরটাকে নিয়ে বেশ একটু ঈর্ষাই করতাম। আজ বুঝলাম ওর ওরম চাবুক চেহারার কারণ কি! মাসে কয়েকবার অবাক জলপান।
1 thought on “অবাক জলপান ২.০”