ভুলে যাওয়া বাঙালি – প্রথম অধ্যায় – শিশিরকুমার ঘোষ

কলমে অনিক সান্যাল

আহঃ….
 
চায়ে একটা স্বস্তির চুমুক দিয়ে কাপটা আস্তে করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন বীরেশ্বরবাবু। কিন্তু তারপরেই ভুরুতে হালকা একটা ভাঁজ পড়লো তাঁর,
” কী ব্যাপার, আজ আবার খবরের কাগজটা দিতে এতো দেরি করছে কেন?”
পাশ থেকে মুচকি হেসে উঠলো বীরেশ্বরবাবুর মেয়ে মন্দিরা, ” তোমার এখনও সেই খবরের কাগজ পড়ার রোগটা গেলো না বাবা।”
” কেন, খবরের কাগজ পড়ায় আবার কি খারাপ দেখলি তুই?” ছদ্ম রাগ বীরেশ্বরবাবুর গলায়।
” নাহ, খারাপ আর কী, পড়া তো ভালই।” উত্তর দিলো মন্দিরা, ” তবে খবরের কাগজে আর কীই-ই বা থাকে বলো? ওই তো চারটে খুন, পাঁচটা ছিনতাই, দুটো রেপ….আর বাকি সব রাজনৈতিক কচকচি। সেরকম খবর, সেরকম রিপোর্টার বা তেমন জার্নালিস্ট আর কোথায় বলো।”
চায়ে আরেকটা চুমুক দিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের প্রবীণ অধ্যাপক বীরেশ্বর সেন। মনে মনেই হেসে উঠলেন তিনি। হ্যাঁ, আজ জার্নালিজম হয়তো একটু হলেও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে, কিন্তু একটা সময় ছিল….আলগোছে মেয়ের দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন তিনি, ” আচ্ছা, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন থাকে দেখেছিস?”
–        “হ্যাঁ, সে আর না দেখার কী আছে। সব কাগজের প্রথম পাতাতেই বিজ্ঞাপন থাকে। সে তো চিরকাল ধরেই চলে আসছে।”
” না, চিরকাল ধরে আসছে না। কোনদিন দেখেছিস, কোনো খবরের কাগজের প্রথম পাতাটা একদম ফাঁকা। কিচ্ছু নেই, কোনো লেখা নয়, কোনো ছবি নয়, একদম সাদা পাতা।”
একটু বিস্ময় ঝরে পড়লো মন্দিরার গলায়, ” একদম সাদা পাতা। তাও আবার ফ্রন্ট পেজ! এরকম হয় নাকি?”
” হয় ” উত্তর দিলেন বীরেশ্বরবাবু, ” হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-এর পরের দিন। কলকাতায় ধর্মের নামে চলতে থাকা নারকীয় তাণ্ডবলীলার প্রতিবাদে একদিন নয়, পরপর তিনদিন সামনের পাতা বিলকুল ফাঁকা রেখেছিল অমৃতবাজার পত্রিকা।”
–        “অমৃতবাজার পত্রিকা? ও তোমার সেই…. কী বেশ নাম যেন ভদ্রলোকের…. কী যেন একটা ঘোষ না বোস….”
“শিশির কুমার ঘোষ”, বীরেশ্বরবাবুর গলায় একটু যেন হতাশাই প্রকাশ পেল, ” বাঙালি আজ শিশির কুমার ঘোষকেও ভুলে গেছে। ভাবা যায়….”
বেশ জমিয়ে বসলো মন্দিরা। বাবার এই হতাশ গলাটা ভালো করেই চেনে সে। এইসময় যুতসই একটা প্রশ্ন করতে পারলেই সকালটা একটা দারুন গল্পের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে। ততক্ষনে ঘুম থেকে উঠে এসে টেবিলের প্রভাতী চায়ের আসরে যোগ দিয়েছে মন্দিরার স্বামী তন্ময়। বিস্কুটের জার থেকে একটা খাস্তা মেরি বিস্কুট তুলে নিয়ে চায়ে ডুবিয়ে একটা কামড় দিতে দিতে সে ঠিক সেই প্রশ্নটা করলো যেটা মন্দিরা করবে বলে ভাবছিল।
–        ” শিশির কুমার ঘোষটা কে বাবা? আপনার এই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা?”
” হ্যাঁ-ও বটে, আবার না-ও বটে”, নড়েচড়ে বসলেন বীরেশ্বর সেন, ” আজ তোমরা যেটাকে এবিপি গ্রুপ বলে চেনো, সেটার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২২ সালে। কিন্তু তার অনেক আগেই, ১৮৭৬ সালে, অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার পলুয়া মাগুরা নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে প্রথম আনন্দবাজার পত্রিকা ছাপা হয় বাংলায়। ছেপেছিলেন শিশির কুমার ঘোষ, তৎকালীন বাংলার এক অগ্নিগর্ভ সাংবাদিক। পরে অবশ্য আনন্দবাজার পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। এই শিশির কুমার ঘোষ-ই আবার ১৮৮৬ সালে নতুন একটা বাংলা পত্রিকা বের করেন, যার নাম অমৃতবাজার পত্রিকা।”
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে চললেন বীরেশ্বরবাবু, ” শিশির কুমার ঘোষের জন্মও ওই মাগুরা গ্রামেই, ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে। বাবা ছিলেন হরিনারায়ণ ঘোষ, যশোহরের ডাকসাইটে উকিল। এই যে অমৃতবাজার পত্রিকার নাম শুনলি, এই নামটা শিশির কুমার দিয়েছিলেন উনার মায়ের নামে, অমৃতময়ী দেবী।”
একটু অধৈর্য গলায় মন্দিরা বলে উঠলো, ” কিন্তু তুমি যে বলছিলে নির্ভীক সাংবাদিকতার কথা, কই, সেসব নিয়ে কিছু বলো।”
” ধীরে, মা আমার, ধীরে”, আশ্বস্ত করলেন বীরেশ্বরবাবু, ” একটু আগেকার কথা না বললে শিশির কুমার ঘোষের সাহস সম্পর্কে কোন ধারনাই করতে পারবি না তোরা। তখন যশোহর জেলায় তেমন ভালো কোনো স্কুল ছিলো না। কিন্তু তাই বলে হরিনারায়ণ ঘোষের ছেলের লেখাপড়া বন্ধ থাকবে? শিশির কুমারকে কলকাতায় পড়তে পাঠালেন তিনি। শিশির এসে ভর্তি হলেন কলকাতার কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে, এখন যেটাকে তোরা হেয়ার স্কুল বলে চিনিস। পড়াশোনায় মেধাবী, বিশেষ করে ইংরিজিতে শিশিরকুমারের পাণ্ডিত্য ছিল সুগভীর। সেটা যতদূর মনে পড়ছে ১৮৫৭ সাল। সেই বছরই প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষা নিচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পরীক্ষার্থীদের প্রথম ব্যাচ, শিশিরও আছেন তাতে। ফলাফল বেরোনোর পর দেখা গেলো শিশির কেবল পাস-ই করেননি, তিনি এক বছরের হিন্দু স্কুল-বৃত্তিও পেয়েছেন। সেই আমলে, যখন লোকে ক্লাস এইট পাশ করলে দল বেঁধে দেখতে আসতো, সেই সময়ে এটা কত বড় অ্যাচিভমেন্ট ভাবতে পারিস?”
” সে তো অবশ্যই”, বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে পাশে এসে বসলেন বীরেশ্বরবাবুর অর্ধাঙ্গিনী মনিদীপা সেন, ” কিন্তু তুমি বেজায় বেলাইনে চলে যাচ্ছ। কথা হচ্ছিল জার্নালিজম নিয়ে, আর সেখানে কিনা….”
” আসছি, আসছি, সেই কথাতেই আসছি”, চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললেন বীরেশ্বরবাবু, ” এঃ, চা-টা জুড়িয়ে গেছে। যাহোক, কী যেন বলছিলাম, ও হ্যাঁ, শিশির কুমার ঘোষের সম্পর্কে। শিশির কুমার এরপর কিছুদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং তাঁর সেরকম পছন্দের নয়। এদিকে প্রায়ই গ্রাম থেকে পড়তে আসা সহপাঠীদের মুখে শোনেন গ্রামের দিকে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের কথা। শোনেন, আর রক্ত গরম হয়ে ওঠে। নাঃ, একটা প্রতিবাদ করা দরকার। কিন্তু একার প্রতিবাদ আর কতদূর পৌঁছাবে? পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন শিশিরকুমার….”
বাধা দিয়ে মন্দিরা বলে উঠলো, ” আচ্ছা, আগেকার দিনে লোকজন এরকম কথায় কথায় পড়াশোনা ছেড়ে দিতেন কেন বলোতো?”
উত্তর দিলেন মনিদীপা দেবী, ” সবাই তো ছাড়তো না। আর যাঁরা ছাড়তেন, তাঁদের জীবনে অন্যরকম কিছু একটা করার অদম্য জেদ, অপরিসীম উৎসাহ থাকতো। অনেক বড়ো কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে যার তলকূল পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আর তাছাড়া, এখন যে লোকে পড়ে, সেও তো সেই চাকরি পাওয়ার জন্যই। চাকরি পেয়ে যাওয়ার পরেও, পড়াশোনাটাকে ভালোবেসে পড়াশোনা চালিয়ে যায় কতজন?”
মৃদু হাসলেন বীরেশ্বরবাবু। যোগ্য জবাব। খালি কাপটাকে নামিয়ে রেখে গলাটা একবার খাঁকরে নিয়ে আবার শুরু করলেন তিনি, ” তখন ১৮৫৯ কী ১৮৬০ সাল মত হবে। নীলকর সাহেবদের দৌরাত্ম চরমে উঠেছে। বিশেষ করে নদীয়া আর যশোহর, এই দুই জেলায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা একরকম দুষ্কর হয়ে উঠেছে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’, বা পরে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ পড়লে এইসব নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তৈরি হবে। অসহায়, নিপীড়িত মানুষগুলোর অব্যক্ত হাহাকার লেখায় তুলে আনলেন শিশির কুমার ঘোষ। মধুসূদন রায়ের পত্রিকা হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এ যশোহরের সংবাদদাতা‌ হিসেবে MLL ছদ্মনাম নিয়ে একের পর এক লিখতে লাগলেন শিশির কুমার। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারলেন, তাঁর কথা তাঁর মতো করে বলতে গেলে কোনো পত্রিকায় লেখা লিখে ছেড়ে দিলেই হবে না। শুধু মানুষের দুর্দশা নয়, তাদের শিক্ষিত করে তোলা, অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ-ও বলতে হবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। ১৮৬২ সালে পাদ্রী বসন্তকুমারের সাহায্যে ৩২ টাকার বিনিময়ে কলকাতা থেকে যশোহরে নিয়ে আসলেন কাঠের তৈরি এক মুদ্রণযন্ত্র, যাকে ইংরিজিতে বলে প্রেস। মনে রাখতে হবে, ১৮৬২ সালে ৩২ টাকা সাধারণ মানুষের পক্ষে জোগাড় করা বেশ কঠিন কাজ ছিল। সমস্তদিন ঘুরে ঘুরে মানুষের দুর্দশার চিত্র নিজে চোখে দেখা, তারপর রাত্রি হলে প্রদীপের দুর্বল আলোতে সেই অভিজ্ঞতাকে অক্ষরের মাধ্যমে কাগজে ফুটিয়ে তোলা, সেখান থেকে কম্পোজ করা, ছাপা, এডিট করা….সমস্ত কাজ প্রায় একা হাতে করতেন শিশির কুমার। একদিকে এই সীমাহীন পরিশ্রম, অন্যদিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য ক্রমাগত হুমকি, লাঞ্ছনা, অপমান – কোনো কিছুই দমিয়ে দিতে পারেনি বছর বাইশ-তেইশের তরুণকে। ১৮৬২ সালে প্রথম প্রকাশ পেলো ‘অমৃত প্রবাহিনী’ পাক্ষিক পত্রিকা। পরে সেই পত্রিকাই ১৮৬৮ সালে অমৃতবাজার নামে আত্মপ্রকাশ করলো যশোহর জেলা থেকে।”
ঘরে পিন পড়লেও শব্দ শোনা যায়। মুগ্ধ হয়ে শুনছেন তিন শ্রোতা। তাদের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে পুনরায় শুরু করলেন বীরেশ্বর সেন, ” তখন ১৮৭১ সাল। অমৃতবাজার পত্রিকা ইতিমধ্যেই বেশ কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলা ভাষায়, বাংলার মানুষের দুর্দশার কথা বলার মত কাগজই বা তখন কোথায়? কিন্তু বাধ সাধলো যশোহরের প্লেগ। শেষমেষ অমৃতবাজার পত্রিকা উঠে এলো কলকাতায়। তবে ভগবান তখনও বোধহয় শিশির কুমারের পরীক্ষা কিছুটা বাকি রেখেছিলেন।”
” কেন? বাকি রেখেছিলেন কেন?” প্রশ্ন করলো তন্ময়।
” ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট”, উত্তর দিলেন বীরেশ্বরবাবু।
” কীসের কী অ্যাক্ট?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মন্দিরা।
সাদা হয়ে আসা চুলের মধ্যে দিয়ে হাতের আঙুলগুলো চালিয়ে নিলেন বীরেশ্বরবাবু, ” ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট। আসলে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ হওয়ার পর থেকে ইংরেজরা এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে কোনোভাবেই ভারতের সাধারণ মানুষের জনমতকে এক হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু পত্র-পত্রিকাগুলো যেভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে খোলাখুলি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠছিল, তা সেই সময়ের ব্রিটিশ শাসকদের যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষ ক্রমশ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে, দুরবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিল। ঠিক এরকম সময়ে, ১৮৭৮ সালে, ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড লিটন নিয়ে এলেন ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট। এই অ্যাক্টের ক্ষমতা অনুযায়ী যেকোন জেলাশাসক বা ব্রিটিশ শাসক চাইলে কোন পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিতে পারতেন শুধুমাত্র তারা শাসক-বিদ্বেষী খবর বা মতামত প্রকাশ করেছে এই অপবাদে। তার জন্য কোন বিচার ছিল না, কোন আপীল করার উপায় ছিল না। এমনকি পত্রিকার প্রকাশক বা সম্পাদকের জেল হেফাজতও হতে পারতো। সে যাই হোক, অমৃতবাজার পত্রিকার জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া। যথারীতি শাসকদের বিষদৃষ্টি গিয়ে পড়লো অমৃতবাজার পত্রিকার ওপর। যতদূর মনে হয়, সেটা ১৮৭৮ সালের মার্চ মাস। কলকাতায় তখনও শীত যাব-যাচ্ছি করেও যায়নি। একমনে নিজের প্রেস-রুমে বসে কাজ করে চলেছেন শিশির কুমার ঘোষ। এমন সময় ভাই মতিলাল খবর নিয়ে এলো ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টের নজর পড়েছে অমৃতবাজার পত্রিকার ওপর। নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে পত্রিকাকে। কিন্তু উপায় কী? ততক্ষনে পরের দিনের পুরো পত্রিকার লে-আউট, খবর ইত্যাদি সমস্ত রেডি হয়ে গেছে, ছাপতে যেটুকু দেরি। আগুন জ্বলে উঠলো শিশির কুমার ঘোষের চোখে। মানে? শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা চাইছে মানুষের স্বাধীন মতামতের ওপর হস্তক্ষেপ করতে? আর্ত, দুঃস্থ মানুষগুলোর কণ্ঠস্বর, কান্নাকে অবরুদ্ধ করতে? কখনোই তা হতে পারে না। অন্তত শিশির কুমারের প্রাণ থাকতে তিনি তা হতে দেবেন না। শুরু হলো এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। সমস্ত রাত্রি জেগে অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন শিশির আর তাঁর ভাই মতিলাল। সকালে সঠিক সময়েই ছেপে বেরোলো অমৃতবাজার পত্রিকা। কিন্তু যেন আলাদিনের এক আশ্চর্য জাদুতে সে পত্রিকার ভাষা পাল্টে গিয়েছে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা পরিণত হয়েছে ইংরিজিতে।”
যেন এক স্বপ্নের ঘোরের ভেতর থেকে জেগে উঠে প্রশ্ন করলো মন্দিরা, ” ইংরিজিতে? মানে?”
মৃদু হাসলেন বীরেশ্বর সেন, ” আসলে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট কেবলমাত্র ভারতীয় ভাষাভাষী পত্রিকাগুলির ওপরেই আরোপিত হয়েছিল। ইংরিজিতে অনেক পত্রিকা ছিল, যারা সর্বক্ষণ শাসকদের গুণগান করেই চলেছে। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তো চলবে না। তাই এই অ্যাক্ট কেবল স্থানীয় পত্রিকাগুলোর অধিকার খর্ব করতেই বিধিবদ্ধ ছিল। এজন্য এই অ্যাক্ট-কে দ্য নেটিভ প্রেস অ্যাক্ট-ও বলা হয়। কিন্তু অমৃতবাজার রাতারাতি নিজের ভাষা বাংলা থেকে পাল্টে করে নিয়েছিল ইংরিজি। ফলে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টের আওতায় আর সে পড়ে না। পত্রিকা প্রকাশেও কোনো বাধা রইলো না।”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন বীরেশ্বরবাবুর স্ত্রী মনিদীপা দেবী, ” তাই বলে রাতারাতি একটা গোটা পত্রিকার সমস্ত খবর ইংরিজিতে অনুবাদ করে ফেলা, এ তো অসম্ভব ব্যাপার।”
” অত্যন্ত কঠিন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই”, বীরেশ্বরবাবু বলে চললেন, ” কিন্তু অসম্ভব যে নয় তার প্রমাণ তো ইতিহাসেই আছে। কী অসম্ভব পরিমাণ ডেডিকেশন, পত্রিকার প্রতি কী অপরিসীম ভালোবাসা, আর হেরে না যাওয়ার কী অদম্য মানসিকতা না থাকলে এই আপাত অসম্ভব সম্ভব হয়, তা মুখে বলতে যাওয়াও হয়তো ধৃষ্টতা। কিন্তু এ তো আর যে-সে লোক নয়। বাংলার শ্রেষ্ঠ জার্নালিস্টদের একজন, যিনি প্রায় একা হাতে একটা যুগান্তকারী পত্রিকাকে দাঁড় করিয়েছিলেন, যিনি ১৮৭৫ সালে ইন্ডিয়ান লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের মানুষদের দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত করার জন্য, যিনি এক রাতে একটা গোটা পত্রিকা ইংরিজিতে অনুবাদ করেছিলেন….ইনি সেই শিশির কুমার ঘোষ।”
তন্ময় প্রশ্ন করলো, ” শিশির কুমার ঘোষ কী শুধু পত্রিকার কাজেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, না অন্যান্য কাজেও তাঁর অবদান আছে?”
” আছে বৈকি, আছে”, উত্তর দিলেন বীরেশ্বরবাবু, ” শিশির কুমার ধর্মে ছিলেন বৈষ্ণব। উনার লেখা অমিয়নিমাই চরিত, কালাচাঁদ গীতা, নিমাই সন্ন্যাসী নাটক….এসব তো বাংলার অমূল্য সম্পদ। শুধু তাই নয়, তিনি বঙ্গীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, উনার চেষ্টায় কলকাতায় গৌরাঙ্গ সমাজ এবং আমেরিকাতে একটি গৌরাঙ্গ মঠ-ও প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয়, ডাকঘর, নৈশ বালিকা বিদ্যালয় প্রভৃতি স্থাপন করেছিলেন। এমনকি বিধবা বিবাহ আইনের প্রতি জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য তিনি নিজে বহুবার তাঁর পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন। পেশার দিক থেকে তিনি ডেপুটি ইন্সপেক্টর ও পরে ইনকাম ট্যাক্স এসেসর-এর কাজও করেন। বুঝলি মন্দিরা, এই হচ্ছে জার্নালিজম। এই হচ্ছে মানুষের বুকের গভীরে জমে থাকা ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তকে অক্ষরের আলপনায় কাগজে বন্দী করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। এই হচ্ছেন শিশির কুমার ঘোষ, যাকে আজ মানুষ স্থান দিয়েছে বিস্মৃতির অন্তরালে।”
লজ্জিত কণ্ঠে কিছু একটা বলে উত্তর দিতে যাচ্ছিল মন্দিরা, হঠাৎ দরজায় ডোরবেল বেজে উঠলো সশব্দে। মনিদীপা দেবী উঠে গিয়ে দরজা খুললেন।
 
কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে গেছে।
 
” এই পত্রিকার জন্যই একসময় বাঙালি কত কষ্টই না করেছে, ভাবলেও অবাক হতে হয়”, আপনমনেই বলে উঠলো তন্ময়।
 
কোনো উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসলেন বীরেশ্বরবাবু। তারপর চেয়ারটা টেনে নিয়ে গিয়ে জানলা দিয়ে আসা হালকা রোদের দিকে পিঠ করে বসে খবরের কাগজে সমাহিত হয়ে গেলেন অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের প্রবীণ অধ্যাপক বীরেশ্বর সেন।

‘ভুলে যাওয়া বাঙালি’ এই শিরোণামে প্রতি বুধবার ও রবিবার আমাদের ওয়েবসাইট www.saptarshinag.in এ প্রকাশিত হবে একটি করে অধ্যায় | আর সেই লেখা হবে তোমাদের | বাংলার এমন কৃতি সন্তানরা যাঁদের আজ মানুষ ভুলে গেছে তাঁদের নিয়ে গবেষনামূলক লেখার সিরিজ এটি | লিখতে হবে বাংলায় | সেরা লেখাগুলো স্থান পেতে পারে kindle এ প্রকাশিত বইয়ে | তাই চটপট পাঠিয়ে দাও নিজের লেখা nagsaptarshi@gmail.com এই মেইল আইডি তে | ওয়ার্ড ফাইল এ শুধুমাত্র পাঠানো যাবে লেখা | লেখার গুণমান বিচার করে শুধুমাত্র ভালো লেখাই কিন্তু প্রকাশ পাবে | শব্দের কোনো সীমারেখা নেই | লেখা পাঠানোর ও ডেডলাইন নেই | এই সিরিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও তোমাদের |

News Reporter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *