ওকে এইভাবে দেখবো কোনদিনও ভাবিনি | বছর সাত আগে দুর্গোপুজোয় শেষ দেখা; পড়নে নীল-হলুদ জামদানি, কপালে ছোট্ট কালো টিপ | আগাগোড়ার মতো দ্রুত পায়ে পেন্সিল হিলের আড়ষ্টতা | জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দুর্গাপুজোর সবচাইতে স্মরণীয় দিন ছিল ওটা | সবে কলেজের গন্ডি পেরোনো ‘একঝাঁক ইচ্ছেডানা’ অষ্টমীর এক মেঘলা সকালে একঝুড়ি কলতান নিয়ে জড়ো হয়েছিলাম সেবার | সেই প্রথম পায়ে হেঁটে গোটা কলকাতা শহরের অলিগলি ঘুরেছিলাম আমি; কিন্তু সমস্ত মণ্ডপে একটাই প্রতিমার মুখ দেখেছিল আমার চোখ; সেই নীল-হলুদ জামদানি পড়া মেয়েটির মুখ |
কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক-এ যাওয়া যাক | আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের গণিত বিভাগের ছাত্র | কলেজের হোস্টেলে সবে মানিয়ে নিতে শুরু করেছি | Real analysis-এর প্রতি মনের ঈশান কোনে সদ্য দানা বাঁধতে শুরু করেছে গভীর অসন্তষের কালো মেঘ | প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া ফিজিক্স বইয়ের মলাটের চেয়ে সদ্য বেড়ে ওঠা দাড়ির যত্ন তখন বেশি | গিটারের নাট পসিশনের কর্ডস-গুলোর সাথে সবে পরিচয় হয়েছে আমার | Instagram-এ 99 পেরিয়ে 100-তে পৌঁছোনো ফলোয়ার্সের অঙ্কটা তখন মাধ্যমিকে অংকে 100 পাওয়ার মতই আনন্দের | আমার century করার এই মহেন্দ্রক্ষনেই সুতপার সাথে আমার আলাপের সূত্রপাত; সেই আমার শততম follower | আর এই কারণেই যে আনন্দটা কয়েক গুন বেড়ে গেছিলো, সেটা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি | তবে পরবর্তীকালে যে সে আনন্দটাই হাই রেট অফ ইন্টারেস্ট-এ চক্রবৃদ্ধি হারে কয়েকগুন বেড়ে আমার দুঃখে পরিণত হয়েছে, সেটাও এখানে বলে রাখা দরকার | আসলে, ওর কারণেই একরকম insta টা খোলা | তবে অনেকবার follow, refollow করার পরও যখন আমার টাইমলাইনে ওর গোটা দুই-তিন পোস্ট ছাড়া অন্য কিছু এলো না; তখন আমার অবৈধ পরামর্শদাতা বন্ধুটির ওপর ভয়ানক রাগ হয়েছিল | তবে সাপে বর হলো, যখন নতুন ইয়ারের ক্লাস শুরু হলো | নতুন বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের বরন করে নিতে ফ্রেসার্স-এর আয়োজন করল তৃতীয় বর্ষের দাদা-দিদিরা | আমার হাজারো বারণ সত্ত্বেও ওরা নাম নিলো আমার; সরচিত কবিতা পাঠ | এমনকি অনুষ্ঠানে না এলে পরবর্তী দিন কলেজে আমার বিশেষ সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করা হবে সেটাও জানিয়ে গেল তারা | অগত্যা আমায় আসতে হলো অনুষ্ঠানের দিন | আলমারিতে পরে থাকা ন্যাপথলিনের গন্ধে সুরভিত দুটো নতুন পাজামা-পাঞ্জাবির একটার ভাঁজ খুলে পড়লাম | অভ্যেস নেই; তাই কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিলো | হাতে মাইক নিয়ে অডিটোরিয়াম ভর্তি একদল ছেলেমেয়ের সামনে কবিতা আবৃত্তির আপাত অসম্ভব চিত্রটা চোখে ভাসতেই; দ্বিতীয় বর্ষেই কলেজ ছেড়ে দেওয়ার একটা চিন্তাও পাশাপাশি উঁকি মারছিলো মনে | যাইহোক অবশেষে এলো সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত; কাঁপাকাঁপা হাতে মোবাইলের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে আরেক হাতে তুলে নিলাম মাইক্রোফোনটা | জীবনে যাকিছু পুন্য সঞ্চয় করেছিলাম, হয়তো সে সবটুকুর বিনিময়ে জগদীশ্বর সে যাত্রায় আমায় উতরে দিলেন | তবে আবৃত্তি শেষে যখন কোলাহলপূর্ণ হলরুমটার দিকে তাকালাম; সামনের সারিতে বসে থাকা সুতপার আমার দিকে তাকিয়ে সহাস্য হাততালি আমার আজও মনে আছে | তারপরই আমার insta ফলোয়ার্সের অঙ্কে সেঞ্চুরি, মেসেজ করে ভালোও বলেছিল | সেই ছিল শুরু| আমি টুকটাক লিখতাম| ওর আমার লেখা ভালো লাগতো | এরপর মাঝেসাঝে এমনিও কথা হয়েছে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নোট বিনিময় হয়েছে | যদিও বাড়ির ফোন বলে ও বেশি একটা আনতো না, তবুও ওর ফোনে আমার “দিপ্তাংশু” নামটা যে ” দীপ্ত ” বলে সেভ করা ছিল, সেটা আমি জানতাম | ওকে যে আগাগোড়াই আমার ভালো লাগতো, এটা আমার বন্ধুরাও জানত | আর শয়তানগুলো খবরটা পুরোদস্তুর রটিয়েও দিয়েছিল | সুতপাও জানত আমি নিশ্চিত | তবু ওকে কোনোদিন মুখফুটে বলা হয়নি | হয়ত একটা ভালো বন্ধু হারানোর ভয় ছিল মনে | যতক্ষণ প্রেম মনের কোণে সঙ্গোপনে কাব্যি করে ততক্ষণ সে সুরক্ষিত | আর যখনই সে মেঘপিয়ন হয়ে তার ডাকবাক্সে ভালোবাসার চিঠি পৌঁছে দিতে যায় তখনই হারানোর একটা ভয় পাশাপাশি কাজ করে |
তারপর কতগুলো বছর কেটে গেছে | আমি graduation পাস করে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গেলাম, সুতপা মাস্টার্সে ভর্তি হলো | শুরুটাই ছিলো সোনাঝরা রোদ্দুরের মত সুন্দর, বাকিটা ধূসর পান্ডুলিপি | প্রথম প্রথম তাও ওর খবর নিতাম, পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইন্যাক্টিভ হয়ে গেল একদম | তবে মাস্টার্স করতে করতেই ওর বিয়ে হয়ে গেছিলো শুনেছিলাম | আমিও নিজের কেরিয়ার, চাকরি বাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম | গোটা চারেক পরীক্ষায় সফলতা, ব্যর্থতার পর অবশেষে চাকরিটা পেয়ে গেলাম | আজ বছর দুই হলো, পারুলদীঘি গ্রামে ব্লক উন্নয়ন অধিকর্তার কার্যালয়ে সহ-কৃষি আধিকারিকের পদে যোগ দিয়েছি | অফিসে কাজের প্রেসার, বাবাকে প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া, তার উপর বিয়ের জন্যে মায়ের দৈনিক হাজারো প্রশ্নের কৈফিয়ত দিতে দিতে সত্যিই বড়ো ক্লান্ত লাগে আজকাল | মা তো একপ্রকার বলেই দিয়েছেন, সামনে ২৯’এর পায়েস তিনি রান্না করে খায়াতে পারবেন না | রোজকার মতো আজকেও আড়াইটেই টিফিন সেরে, পাশেই দুলাল দার দোকানে চা খেতে গেছিলাম | চা খেয়ে অফিসে ঢোকার সময় ব্লক অধিকর্তার ঘরটার সামনে বেঞ্চিতে একজন ভদ্র মহিলা আর একটি বছর চারেকের বাচ্চা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালাম| কিছুক্ষনের অপলক নিরীক্ষণ | আমার অতীতের পলি পড়া স্মৃতিতটে সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ছে | নাহ, আমি চিনতে ভুল করিনি; এটা সুতপা-ই | আগের চেয়ে অনেকটা মোটাসোটা হয়েছে; চোখের চঞ্চল দৃষ্টি এখন স্থির, মেঘে ঢাকা তারার মতো আবছায়া | আমি বারীন দার ছ’ফুট বাই সাত’ফুটের চেম্বারটায় ঢুকে পাশের চেয়ারটা অধিকার করলাম | অফিসের সর্বজ্যেষ্ঠ, হিসেবরক্ষক বারীন বোস হিসেবের খাতায় মুখ গুঁজেই ‘হুম’ একটা শব্দ করে আমায় স্বাগত জানালেন | চেম্বারের সামনের সরু গ্রিল আর কাঁচের সামিয়ানাটা নিচের দিকে এসে টেবিলের উপর মাঝখানটায় যে ছোট অর্ধবৃত্তাকার শুন্যতার সৃষ্টি করেছে , সেখান দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম বেঞ্চের দিকে | প্রথমটায় ঠিক খেয়াল করিনি; এখন দেখলাম; সুতপা একটা সাদা কাপড় পরে আছে | একদম সাদা নয়, তবে প্রায় সাদা | তাহলে কি শ্বশুর,শাশুড়ী মারা গেলো !! কিন্তু এর পরেই আমার মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেলো; হুহু করা বুকে শিরায় শিরায় রক্তের ঢেউ তুলে আমার চোখ তখন ওর সিঁথি, হাতের কব্জি ছুঁয়ে এসেছে | সুতপা বিধবা | তবে রিসেন্টলিই হবে | কারণ মাস ছয়েক আগেও তো সৌমিকের সাথে দেখা হয়েছিল; কিছু বলেনি তো ও | সুতপার শ্বশুরবাড়ির ওদিকেই ওর বাড়ি | এতদিন পর ঈশ্বর দেখা করালেন ঠিকই, কিন্তু মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে | আমার নিজের অজান্তেই চশমার কাঁচে ঢাকা দৃষ্টিকোনে বিন্দু বিন্দু জলকণা এসে জমা হয়েছে | আমার দুচোখে তখন হাজারো লাল-নীল স্বপ্নেরা নোনাজলে স্নান করছে | ওকে এভাবে কোনোদিন দেখতে হবে ভাবিনি | এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা | হঠাৎ আমার ঘোর ভাঙলো, যখন দেখলাম সুতপা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে সামনের ঘরের দিকে এগোচ্ছে | কিছু না ভেবে আমিও উঠে পরলাম, চেম্বার থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে এগিয়ে গেলাম বেঞ্চের দিকে | বেঞ্চের উপর তখন একলা বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটি একবার ঘার ঘুরিয়ে আমায় দেখলো, তারপর আবার তার দুহাতের শক্ত মুঠোয় ধরা সেলফোনটার দিকে মন দিল | আমি বোকার মতন পকেট হাতরে বের করা তিনটে eclairs তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম| ছেলেটি নিল, কিন্তু কোনো কথা বললো না | পুনরায় ওগুলো পকেটের অন্তর্গত হলো | ‘কি পড়াশুনো করো ?’, উত্তরে জবাব এলো ‘হুম’ | মা ছাড়া একা অচেনা জায়গায় একটু হলেও ভয় পাচ্ছে নিশ্চই | একবার মনে হলো ওকে এখানে আসার কারণটা জিজ্ঞেস করি, কিন্তু অতটুকু ছেলে ওই বা কি জানবে !! আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘ কি নাম তোমার ??’ এবার কিছুটা অকপট স্বরে জবাব এলো ‘ দীপ্ত,দীপ্ত বসু ‘ | আমার সেলফোনটা ঠিক সেইসময়ই বেজে উঠে তার উপস্থিতির জানান দিল | মা ফোন করেছে, ” কিরে আজ নাহ বাড়িতে মেয়ের বাড়ির লোক আসার কথা | ভুলে যাস নাকি !! নাহ, বাড়িতে আসতে মন চাইনা তোর ??” টিপটিপ করে বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে | ছাতাটাও সঙ্গে আনিনি | মনে হয় মুষলধারায় বৃষ্টি হবে ||
দীপায়ন দাস , নবদ্বীপ, নদীয়া
Review of Squid Game…
Read the review of Uncut Gems here
To read my review of Money Heist click here