সপ্তর্ষি নাগ
প্রায় বছর বারো আগের কথা | ছোট শহর তখন সবে বড় হচ্ছে | তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে তার গায়ে | আর আধুনিকতার জোয়ারে অনেক স্মৃতির বুকে হানা হচ্ছে আঘাত | এমনই এক স্মৃতি ছিল শহরের সবচেয়ে পুরোনো সিনেমা হল | আহা ! সাত বছর বয়সে স্পিলবার্গের জস সিনেমা দিয়ে বাবার সঙ্গে ওখানে প্রথম পদার্পণ | তারপর থেকে কত সুখস্মৃতির সাক্ষী সে | মাঝেমাঝেই রবিবার চ্যারিটি শোতে হলিউডকে কাছে পেতাম সেখানে | স্কুল পালিয়ে সেখানে যাবার প্রয়োজন পড়েনি কারণ আমার বড় হওয়ার অন্যতম সঙ্গী হবে সিনেমা সেটা বুঝে মা বাবার আমার সিনেমা দেখাতে তেমন আপত্তি ছিল না | ছোট শহরে সিনেমা দেখলেই বখে যাওয়ার চলতি ধারণাকে ভাঙবার জন্য অবিশ্যি বাবা-মা কে কম কথা শুনতে হয় নি | একজন শিক্ষক যেচে একবার উপদেশ ও দিলেন – চরিত্রস্খলনের প্রথম ধাপ সিনেমাপ্রেম | আহা ! মানিকবাবু তখনো বেঁচে | তাঁর কানে একবার যদি কথাটা পৌঁছানো যেত ! সে যাইহোক, সব জ্ঞানের নিকুচি করে সিনেমা দেখাটাকেই হবি বানিয়ে নিলাম | মানে প্রথম প্রেম হয়ে গেল বড় হওয়ার একটা অংশ | আর সেই ভালোবাসার আঁতুর ঘর ছিল শহরের সেই সিনেমাহল | তার বুকে যখন আঘাত পড়লো মনে হল ছেলেবেলাটা যেন কেউ নিমেষে কেড়ে নিলো | কিন্তু ওই যে আধুনিকতা ! পা মিলিয়ে না চললে পিছিয়ে পড়তে হবে | পাঁচ টাকার চানাচুর বা ডালমুট দিয়ে কি সিনেমা দেখে ভদ্রলোকে ! টিকিটের চেয়েও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে পপকর্ন, কোল্ড ড্রিঙ্কস | কুরোশাওয়া নয় কুর্শি তে শুয়ে দেখতে হবে সিনেমা | ভোগ আর পণ্যের চাপে পিছু হটলো সাবেকিয়ানা | যেখানেতে সিনেমা হল ছিল ওখানে হল শপিং মল |
কিন্তু কপালের লিখন খন্ডায় কে? করোনা যেন এসেছেই নবযুগের সব বিলাসিতার সত্যনাশ করতে | ভোগবাদী সমাজে যেন চে-র মতো ধেয়ে গেছে সে | আর তারই প্রকোপে এই সেদিন হা রে রে রে করে সব সাবেকি সিনেমাহলের লালবাতি জ্বালানো সিনেপ্লেক্সগুলো ও পথে বসতে চললো | ইসস ! যখন ছোট ছোট শহরগুলোতে এইসব সিনেপ্লেক্সগুলো ব্যবসা শুরু করেছিল কি বুক ফুলিয়েই না ধ্বংস করা হয়েছিল পুরোনো সেই হলগুলোকে ! এসিতে বোসে পপকর্ন খেয়ে পা দুলিয়ে মানুষ সুন্দর পুরোনো স্মৃতিগুলোকেও কত সহজে হারিয়ে যেতে দিয়েছিল ! সেদিন শহরের বড় সিনেপ্লেক্সটার দিকে তাকিয়ে আবারও একটু হলেও আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলাম | বক্স অফিসে মাস চারেক আগের পুরোনো ছবির পোস্টার | সেটা ওঠানোর ও লোক নেই |হাজার হোক, কত মানুষের রুজি রুটির যোগান দিতো সেটা | না হয় একটু কনসুমারিসম চলতো | তাতে কি ! কিন্তু ওই যে কর্মফল ! বছরদশেক আগে এক পড়তি সাবেকি হলে একটা পুরোনো ছবি দেখতে গিয়েছিলাম | তার মালিক সেদিন মাথা চাপড়ে বলছিলেন – মানুষ এতো সহজে সব ভুলে যায় ! আর আজ মানুষ পেয়ে গেছে আমাজন, নেটফ্লিক্স, হটস্টার | যে টাকা দিয়ে দুজন মিলে একটা বড়জোর সিনেমা দেখা যেত সেটা দিয়ে সারা মাস যত খুশি, যেখানে খুশি, যা খুশি সিনেমা দেখা যাবে | তার উপরে আবার করোনার ভয় ! আদৌ কবে এসব সিনেপ্লেক্সের সিটগুলোর ধূলো মোছা হবে কেউ জানে না | আদৌ হবে কি? আসলে সময় বড় নিষ্ঠুর যে ! কারো তোয়াক্কা করে না ! সেদিন ছোট সিনেমাহলগুলোর মালিকরা মাথা চাপড়েছিলেন ! আজ পালা এই সব ঝাঁ চকচকে হলের মালিকদের !
মানিকবাবু, কুরোশাওয়া, স্কোরসেসে, নোলান আমার সঙ্গেই আছেন যদিও | থাকবেন চিরকাল ও | শুধু ওনাদের কাছে পাওয়ার যোগসূত্র হয়তো বদলে যাবে এমনই করে, কালচক্রের আবর্তে |
আমার প্রথম সিনেমা হলে সিনেমা দেখা রূপশ্রী তে।টাইটানিক।সেই প্রথম সিনেমাহলের সাথে আমার পরিচয়।সেই সময় সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বিরাট ব্যাপার ছিল।এত বছর পর আজও ডি.বি.সি রোড দিয়ে যেতে যেতে পুরোনো রূপশ্রী হল টাকে মিস করি।