লেখক – সপ্তর্ষি নাগ
অনির্বাণ রায়, জলপাইগুড়ির প্রাণকেন্দ্র কদমতলার পাশে শহরের সবচেয়ে পুরোনো লাইব্রেরিটার একমাত্র লাইব্রেরিয়ান ও কর্মী | আজকাল এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে লাইব্রেরিতে পাঠক আর কোথায়? বাজারে জিনিসের দাম আর বাড়িতে সমস্যা হুহু করে বাড়লেও অনির্বাণের বেতন আর বাড়েনা | বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে | বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর হল | বাবার ফেলে যাওয়া ব্যাংক লোন শোধ করতে হচ্ছে ওকেই | মা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী | একমাত্র ছেলের জন্ম থেকেই হার্টের সমস্যা | আর্থিক টানাপোড়েনে জেরবার অনির্বাণের সংসার I
আজ সকাল থেকেই একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে | আকাশ পুরো কালো হয়ে আছে | রাস্তাও জনমানবশূন্য | অন্য দিন তাও কয়েকজন বয়স্ক মানুষ খবরের কাগজ পড়তে আর কিছু পরীক্ষার্থী চাকরির পরীক্ষার বইপত্র পড়তে আসে | কিন্তু এই দুর্যোগের দিনে কে আর বই পড়তে আসবে? সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ লাইব্রেরি বন্ধ করার কথা ভাবছিল অনির্বাণ
| হঠাৎ করে লোডশেডিং | বৃষ্টির ছাট আর দমকা হাওয়া থেকে রক্ষে পেতে দরজা জানালা সব আগেই বন্ধ রেখেছিল অনির্বাণ | এর মধ্যে লোডশেডিংএ মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠল | খান দুয়েক মোম জ্বালিয়ে উঠবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ও | হঠাৎ করে লাইব্রেরির দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ |
এই দুর্যোগে কার আবার বই পড়ার শখ হল | ভারি জ্বালা তো!
দরজা খুলতেই এক কিম্ভুতকিমাকার মানুষের দেখা | সাদা পাজামা, হরেক রঙের পাঞ্জাবি, একটা নাগরাই জুতো,কাঁধে একটা পেল্লায় সাইজের কাপড়ের ব্যাগ আর চোখে কুচকুচে কালো চশমা | অনেকটা ছানি অপারেশনের পরে যে চশমা পরে লোকে | মাথার সাদা চুলে জট বাঁধতে বসেছে | উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ ফুট হবে |
অনির্বাণ কিছু বলার আগেই অদ্ভুতদর্শন লোকটা ছাতা হাতে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ল |
‘ঘোর কলি মশাই! ঘোর কলি! বৃষ্টির দিনে একটা রিকশা পর্যন্ত মেলেনা এই শহরে | আর অন্য সময়ে টোটোর অত্যাচারে রাস্তায় পা ফেলা দায় |’- ছাতাটা মেলে মেঝের উপরে রাখতে রাখতে মন্তব্য লোকটার I
‘সে বুঝলাম খন | কিন্তু লাইব্রেরি তো এখন বন্ধ হয়ে যাবে | আপনি বরং কাল আসুন ‘- বিরক্ত অনির্বাণের জবাব |
‘ সে কি মশাই! বাইরে যে ফলাও করে লিখে রেখেছেন রাত আটটা অবধি খোলা থাকে | ‘
মোমবাতির মৃদু আলো, বাইরে বৃষ্টির শব্দ, ঘরের ভেতরে কেমন ভ্যাপসা গন্ধ মিলিয়ে একটা বিকট পরিবেশ, তার উপরে আবার এই বিকটাকার লোকটার গঞ্জনা! তিতিবিরক্ত অনির্বাণ বলল – ‘ আপনার কার্ড আছে | না থাকলে পরে এসে কার্ড করিয়ে বই নেবেন |’
‘ আরে রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি একটা বই পড়তে এসেছি | অবিশ্যি সেসব বই আপনারা রাখেন কিনা আমার সন্দেহ |’
লাইব্রেরিতে আজকাল পাঠক না থাকুক, বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে কিছু বললে অনির্বাণের ভারি গায়ে লাগে | বইগুলোকে ভারি ভালোবাসে ও | অভাবের সংসার, রোজ বাড়ির কিছু না কিছু সমস্যা, নেট খুললেই সফল বন্ধুদের সাফল্য উদযাপনের ছবি দেখে হতাশা – এসবের মাঝে ওই বইগুলোই তো ওকে সাময়িক শান্তি দেয় | প্রতিটা আলমারির প্রতিটা তাকের সব বই ওর চেনা, পড়া |
এহেন বইশ্লাঘায় আঘাত লাগায়, ভেতরে চটলেও বেশ গর্বের সঙ্গে অনির্বাণ জিজ্ঞেস করলো ‘নাম বলুন বইয়ের |’ নিজের চেয়ারে বসে বলল ও |
‘ না সেরকম নির্দিষ্ট কোনো বই না | তোরাজা সম্প্রদায় নিয়ে কোনো বই আছে আপনার?’
‘ কি নিয়ে? তোরাজা?’- নামটাই প্রথম শুনলো অনির্বাণ |
‘সে কি মশাই! তোরাজা নাম শোনেন নি? নাহ, বড় আশা ছিল আপনার এই লাইব্রেরির উপরে |’
‘না মানে ইয়ে এরকম বই তো কখনো কেউ চায়নি, তাই আর কি ‘- আমতা আমতা করে জবাব অনির্বাণের |
‘ আহা, কি দুর্দান্ত তাঁদের গল্প | ওরা নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে মৃত্যুর পরেও ছাড়ে না জানেন? ‘
গা খানিকটা শিউড়ে উঠলো অনির্বাণের | চারিদিকে বেশ একটা ছমছেমে ভাব |
‘ দুর মশাই | আমায় এই বৃষ্টি মাথায় বাড়ি যেতে হবে | ওসব গাঁজাখুরি গল্প পরে শোনাবেন একদিন |’
‘ মোবাইলে একবার দেখুন না | লিখুন না ওখানে, তোরাজাদের কথা | বুঝবেন আমি সত্যি বলছি কিনা |’
সঙ্গের পুরোনো মোবাইলে ইন্টারনেট চলে না | অগত্যা বেয়াদপ লোকটার কথা বিশ্বাস করা ছাড়া আর উপায় নেই |
‘ তাড়াতাড়ি শেষ করুন | আমি শুনছি |’
‘সত্যি বলছি আপনার বেশি সময় নেবো না | তবে ইন্দোনেশিয়ার পার্বত্য এলাকা দক্ষিণ শুলায়েসীর তোরাজাদের এক রোমহর্ষক গল্প শুনলে আপনি ও চাবেন ওঁদের নিয়ে পড়তে, জানতে, বই আনতে, মানুষকে জানাতে |’
পড়তে ভারি ভালো লাগে অনির্বাণের | আর্থিক অবস্থার কারণে পড়াশুনো করার ইচ্ছে থাকলেও বেশিদূর এগোয় নি, গ্রাজুয়েশন এর পরেই এই অল্প বেতনের চাকরি পেয়ে সেখানেই এতটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে | নতুন কিছু জানার আগ্রহ এখনো আগের মতোই |
‘ আচ্ছা বলুন ‘ – খানিকটা হতাশ গলায় বলল সে |
‘ আপনার বেশি সময় নেব না কথা দিলাম | শুনুন তবে ‘|
লাইব্রেরিয়ানের ডেস্কের সামনের লাল প্লাস্টিকের চেয়ারটাতে বসে খানিকটা খুকখুক করে কেশে শুরু গল্প শুরু করলেন সেই পাঁচ ফুটের লোকটা |
ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ শুলায়েসীর এক বহু পুরানো উপজাতি এই তোরাজারা | তোরাজা শব্দের মানে হল উচ্চভূমি | এদের নিজস্ব এক ধর্ম আছে | তার নাম আলুক | মানে পূর্বসূরীদের পথ | এদের ভাষার নাম বুগিনী | আজকাল সভ্যতার ছোঁয়া লাগলেও আমি যেসময়ের গল্প বলছি তখন এরা একেবারেই আদিম সভ্যতাকে নিয়েই বাঁচতো | সময়টা বিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকে | ছোট ছোট গিয়াস বা রাজভূমিতে ভাগ ছিল এদের রাজ্য | আর প্রতিটা গিয়াসের একজন স্বাধীন রাজা ছিলেন | ভারি শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিল এঁরা | বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল ওঁদের মধ্যে | বরং প্রিয়জন মারা গেলে তাঁকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এঁরা যত্ন করে সঙ্গে রেখে দিত সেই মৃতদেহ | এই সময়ে নাকি সেই মৃতকে ওঁদের দেবতা পুয়াঙ্গ মাতোয়ার কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি চলত | শুদ্ধ আত্মা সেই দেবতার বাসভূমি পুয়াতে যায়, এটাই বিশ্বাস ছিল তোরাজাদের |
এমনই এক রাজা ছিলেন সুরান | তাঁর সহজ সরল জীবনযাত্রা, জনদরদী কাজকর্ম সবকিছুতেই পরীহা গিয়াসের মানুষদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন সুরান | আর তাঁর রানী ছিলেন তুয়ালি | রাজা -রানীর ভালোবাসা গল্পগাঁথার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো | মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে রানীর মৃত্যু হয় | শোকে পাথর হয়ে যান রাজা সুরান | নাওয়া খাওয়া ছেড়ে রানীর দেহ নিয়ে নিজের তাবুতে দিন কাটে তাঁর | রানীকে প্রথা মেনেই চিকাল ওষুধ মাখিয়ে তাঁর দেহ সংরক্ষণ করা হয় | প্রতিদিন নিয়ম করে নিজের হাতে মৃত রানীকে স্নান করাতেন রাজা সুরান | রানীর গলায় ছিল বিশাল এক সোনার হার | ওঁদের ভাষাতে পিতাশ | তার উপরে খোদাই করা ভগবান পুয়াঙ্গ মাতোয়ার অবয়ব |
এরকম করে কাটতে থাকে মাসের পর মাস | বছরের পর বছর | প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠলেও প্রিয়তমা রানী তুয়ালিকে একই রকম ভালোবাসতেন সুরান | তাঁদের বিছানাও ছিল একই | ধীরে ধীরে বাড়ছিল ওঁদের একমাত্র পুত্র তালান | হঠাৎ একদিন খবর এলো গিয়াসে ধেয়ে আসছে ডাচ সৈন্যরা | শান্তিপ্রিয় তোরাজারা কেমন করে লড়াই করবে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে? সুরান রাজা তাঁর সৈনিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে রাতের বেলায় তাবুতে ফিরলেন | পুত্র তালান তখন খেলছে দেহরক্ষী চিনুয়ার সঙ্গে | তুয়ালি রানীর দেহ বিছানায় | চিনুয়াকে বিশ্রাম নিতে বলে রাজা কোলে তুলে নিলেন তালানকে | কপালে দিলেন স্নেহচুম্বন | আর তুয়ালিকে জড়িয়ে ধরলেন রাজা | হেরে যাচ্ছেন সুরান | কিন্তু স্ত্রী – পুত্রকে ছাড়বেন না তিনি |
নিঃশ্বাস নিতে থামলেন সেই লোকটা | অনির্বাণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল | একটা মোমবাতি নিভে গেল |
নিভুক গে | এরকম গল্প আগে কখনো শোনেনি সে |
একটা জলের বোতল বাড়িয়ে দিল ও লোকটার দিকে | এক লহমায় পুরো বোতল খালি করে আবার গল্প শুরু করলেন সেই অদ্ভুত লোকটা |
হঠাৎ করে তাবুতে প্রবেশ করলো দুই ওলন্দাজ সৈনিক | তরোয়াল নিয়ে ধেয়ে এলো রাজার দিকে | একজনের চোখ রানীর গলার সেই বিশাল সোনার হারটার দিকে | রাজা সুরান বীরবিক্রমে বাধা দিলেন | তাঁর কোলে ছোট্ট তালান কাঁদছে | সারা গিয়াসে তখন চলছে তান্ডব | একের পর এক তোরাজাকে মেরে ফেলছে ওলন্দাজ সৈন্যরা | রাজার লড়াইয়ের শক্তিও শেষের পথে | কিন্তু কিছুতেই রানী তুয়ালি আর ছেলে তালানকে হাত লাগাতে দেবেন না তিনি | হঠাৎ চিনুয়া ঢুকলো তাবুতে | বীরবিক্রমে দুই ওলন্দাজ সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সে | তরোয়ালের ঝনঝন শব্দে ভয়ে কেঁপে আরো কাঁদছে তালান | রাজা সুরান ক্লান্ত | কিন্তু লড়াই থামাবেন না তিনি | আর চিনুয়ার প্রচন্ড শক্তিতে হার মানছে দুই সৈন্য | একজন ছোট্ট তালানকে ছিনিয়ে নিল রাজার কোল থেকে | হতভম্ব সুরান কিছু বুঝে ওঠার আগেই বীরবিক্রমে সেই সৈন্যকে মেরে ফেললো চিনুয়া | চিৎকার করে বলল – আমি আছি | আপনি রানীমা আর তালানকে নিয়ে চলে যান তাবুর পাশের সুড়ঙ্গ দিয়ে | নদীর তীরে নৌকো রাখা আছে | হঠাৎ চিনুয়ার বুক ভেদ করে ঢুকলো ওলন্দাজ সৈন্যের তরোয়াল | সেই অবস্থাতেই সেই সৈন্যকে আঘাত করলো চিনুয়া | এক কোপে তার মুন্ডচ্ছেদ করলো সে | আর চেঁচাতে থাকলো – রাজামশাই, তাড়াতাড়ি চলে যান | সুরান তাড়াতাড়ি তুয়ালি আর তালানকে নিয়ে চললেন সুড়ঙ্গপথে | পড়ে রইলো চিনুয়ার নিথর দেহ | শেষবার যখন সুরান চিনুয়াকে দেখলেন, তাঁর চোখে শুধুই কৃতজ্ঞতা |
চোখ ছলছল করছিল অনির্বাণের | তোরাজাদের সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানতো না ও | হঠাৎ দেখলো সামনে কেউ নেই | প্লাস্টিকের চেয়ারটা ফাঁকা | শুধু ডেস্কের উপর সেই পেল্লায় ব্যাগটা |ভয়ে বুক কেঁপে উঠল ওর | এই এক পলক আগেও তো ওখানে বসে ছিলেন মানুষটা| কোথায় গেলেন? হঠাৎ লাইট চলে এলো | ভয়ে ভয়ে ব্যাগটায় হাত দিল অনির্বাণ | হয়তো সেখানে কোনো নম্বর পাওয়া যাবে | ব্যাগ খুলতেই চকচক করে উঠলো একটা বিরাট কি যেন | আর সঙ্গে একটা কাগজ | জিনিসটা বাইরে আনতেই স্তম্ভিত হল অনির্বাণ | বিরাট একটা সোনার হার | উপরে খোদাই করা এক অদ্ভূত ছবি | মনে হয় কোনো দেবতার | আর কাগজটাতে লেখা
‘ ভালো থেকো চিনুয়া | এই হার তোমার সব সমস্যা মেটাবে আশা করি | তোমার ঋণ হয়তো জন্মজন্মান্তরেও শোধ করতে পারবো না |
তোমার ছোট্ট তালান ‘
বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ তখন কমের দিকে |
Copyright © Saptarshi Nag
এই গল্পের বিষয়বস্তু কাল্পনিক হলেও তোরাজাদের উপর সমস্ত তথ্য লেখকের দীর্ঘ গবেষণাভিত্তিক |