সপ্তর্ষি নাগ
সুনীল ছেত্রীর বিদায়বেলাতে অশ্রুশিক্ত ভারতীয় ফ্যানদের দেখে বা নিজের চোখের কোণে অজান্তে চলে আসা একবিন্দু অশ্রু অনুভব করে মনটা কেমন হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল এদেশের ফুটবলের বিস্মৃত গৌরবগাঁথায়। হারিয়ে গেল ষাট – সত্তর বছর আগের সেই ভারতীয় ফুটবলের যুগে, যেই সময়কালকে সাম্প্রতিককালে অজয় দেবগনের ‘ময়দান’ ছবিতে সুন্দক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। না না, এটা কোনো রিভিউ না। বরং বলতে পারি, এদেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগের প্রতি বা সেই যুগকে আজকের হোয়াটস্যাপ বিশেষজ্ঞ জামানাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সাহস ও ঝুঁকি নেওয়ার জন্য এই ছবির নির্মাতা ও অভিনেতাদের প্রতি এই তুচ্ছ ক্রীড়াপ্রেমীর নতমস্তকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
স্বাধীনতার ঠিক পরের সময়টায় এদেশ যখন দেশভাগের গ্লানি, পরনির্ভরতার যন্ত্রণায় পীড়িত, দেশ তখন এমন কিছু মুহূর্ত চেয়েছিলো যা সেই সময়কার আঞ্চলিকতাকে ছাপিয়ে দেশকে একসূত্রে গাঁথতে পারে। পারে সাধারণ মানুষের কাছে তিরঙ্গার মর্যাদাকে উপলব্ধি করাতে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বাইরে গিয়ে, ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডি পেরিয়ে দেশকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় শ্রদ্ধার আসনে আসীন করতে। কিন্তু গান্ধীজির মৃত্যুপরবর্তী রাজনৈতিক বাতাবরণে, চতুর্দিকে জ্বলতে থাকা হিংসার আগুনে কিংবা সদ্য স্বাধীন দেশের নানাবিধ সমস্যার নাগপাশে সেসময় রাজনীতিবিদদের পক্ষে রাজনৈতিক সংকীর্ণতার গন্ডি পেরিয়ে এই নবজাগরণের দ্যুতি ছড়ানো সম্ভব ছিল না। ক্রীড়াজগতে হকি তখন ভারতের শান। কিন্তু হকিও আঞ্চলিকতার স্বীকার। এদেশকে এক সূত্রে গাঁথায় অক্ষম ছিল হকি ও। সেসময় জাতীয় হকি টিমের প্রায় ৯০% খেলোয়াড় পাঞ্জাব থেকে আসা। ক্রিকেট ও তখন বড়লোকের বিলাসিতার খেলা। ক্লাস থেকে মাসে পৌঁছানোর সামর্থ্য তার ও ছিল না, দেশকে এক মালায় গাঁথা দূরঅস্ত।
ঠিক এই সময় এদেশের ফুটবল পায় এমন একজন মানুষকে যিনি আজকের দিনেও পূজ্য হতে পারেন তাঁর দূরদর্শীতা, ফুটবলে আধুনিতার প্রথম প্রয়াস, প্রথবিরোধী রাস্তায় হাঁটা বা দেশকে এমন সাফল্য এনে দেওয়ার যা এদেশ তার পর থেকে আজ অবধি পেরে উঠতে পারেনি। গোটা বিশ্ব যখন ২-৩-২-৩ বা ৩-৩-৪ ছকে খেলছে তিনি প্রতিপক্ষকে তাক লাগিয়ে দিতেন ৪-২-৪ ছকে। একক দক্ষতায় নয় বরং সবার প্রচেষ্টায় ম্যাচ জেতা এই মন্ত্রে দলকে উজ্জীবিত করতেন সেই মানুষটি। যে কোনো খেলোয়াড়কে দলের প্রয়োজনে যে কোনো জায়গায় ওঠানামা করে টোটাল ফুটবল খেলা, যেটা কিনা আরো কয়েক বছর পরে ডাচ ফুটবলের ঘরানা হয়ে ওঠে, প্রথমবার তো তিনিই সেকথা বলেন। আজও আধুনিক ফুটবলে প্রচন্ড কার্যকরী ফর্মুলা বক্সের ভেতরে প্রতিপক্ষকে টেনে এনে তারপর কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করা, তিনি ছিলেন তার অন্যতম জনক। এদেশের ক্রীড়া আজও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার শিকার। তখনও ভয়ঙ্কর রূপেই বিরাজমান ছিল এই নোংরামো। আর সেই নোংরামির শিকার তাঁকে হতে হয়েছিল বারংবার। কিন্ত হার মানেন নি তিনি। নশ্বর মনুষ্যজাতির ক্ষমতা ছিল না সেই মানুষটিকে হার মানাতে। তাই সব চক্রান্তকে হার মানিয়ে তিরঙ্গার জয়জয়কার দেখেই থামেন তিনি। থামতে হয় ক্যান্সারের হাতে। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তাঁর জীবনরথের চাকা থেমে যায়। তিনি সৈয়দ আব্দুর রহিম বা রহিম সাহেব, ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সর্বসেরা কোচ। আর আগামী ১২ই জুন তাঁর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার ৬১ বছর।
(চলবে )