প্রায় বছর চল্লিশ আগের কথা ।জলপাইগুড়ি শহরের পি ডি উইমেন্স কলেজে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ছে পুতুল। কলেজসংলগ্ন হোস্টেলেই থাকছে।বাড়ি মেটেলির কাছাকাছি । এমনিতে তেমন দূরে নয়। কিন্তু সেসময় যোগাযোগব্যবস্থা তেমন ছিল না। তাছাড়া খরচও হত বেশ। পুতুল মাসে একবার বাড়ি যায়। বান্ধবীরা বেশির ভাগই শুক্রবার বিকেলে বাড়ির বাস বা ট্রেন ধরে। ওর ঘরে ওরই সঙ্গে থাকে আরো তিনজন। রুমেলা, সাবিত্রী আর নয়না। ওদের বাড়ি কাছাকাছিই। হলদিবাড়ি, ময়নাগুড়ি আর ধূপগুড়ি।
এসপ্তাহে যথারীতি ওর রুমমেটরা শুক্রবার হতেই বাড়ির রাস্তা ধরেছে। রুমেলা তাও শনিবার সকাল অবধি ছিল পুতুলের আবদারে। শেষমেষ বেলা এগারোটা নাগাদ ও বেরোলো। সামনের সপ্তাহে হয়তো আসবে না ও বাড়ির কোনো একটা পূজো আছে। তাই পুতুলের আবদার রাখতেও তেমন অসুবিধা হয়নি। ওর খবর না পেয়ে আগের রাতে বাড়ির থেকে ট্রাঙ্ক কল এসেছিল। খবর পেয়ে বাড়ির লোক নিশ্চিন্ত হয়। পুতুলের সেরকম ঝামেলা নেই। বাড়ির লোক জানে ও মাসের শেষ সপ্তাহে বাড়ি যাবে। বাড়ির লোক বলতে তো দুজন। ওর মা আর দাদা। বাবা চলে গেছেন ওর যখন পাঁচ বছর বয়স ছিল। মা ও বেশ কিছুদিন থেকেই নানা অসুখে ভুগছেন। বাড়ির হাল দাদার উপরে। বাড়ির সঙ্গেই লাগোয়া একটা মুদির দোকান থেকে যেটুকু উপার্জন হয় তা দিয়েই সংসার চলে। ও নিজে তেমন পড়াশুনো করেনি। কিন্তু বোনটার পড়াশুনোর দিকে ওর খুব নজর। ওর মা বলে এটা নাকি দাদা বাবার থেকে পেয়েছে। খেয়ে না খেয়ে থাকলেও বাড়ির মেয়েকে উচ্চশিক্ষা দিতেই হবে – এটা নাকি বাবা বলতেন। বিয়ের পরে মা’কে মাধ্যমিক পাশ ও করান বাবা।
আজ সকাল থেকেই আকাশ কেমন যেন মন খারাপ করে আছে। বৃষ্টির দেখা নেই। কেমন একটা গুমোট ভাব। এরকম দিনগুলোতে বড্ড বাড়ির কথা মনে পড়ে পুতুলের। আজকেও মন খারাপ করছিলো। গতবার বাড়ির থেকে আসার পর থেকেই মনটা তেমন ভালো নেই। মা’র শরীরটা নিয়ে চিন্তাও হয়। বাড়ির কাছেপিঠে ভালো কোনো কলেজে অনার্স পেলে হয়তো এতদূর আসতেও হত না।
সারাদিন শুয়ে বসে আর একটু আধটু পড়াশুনা করে কাটিয়ে দিল পুতুল। সন্ধ্যা থেকেই আবার লোডশেডিং। হোস্টেল থেকেই প্রতি রুমে একটা করে লণ্ঠন দেওয়া আছে। অন্যান্য শনিবার বিকেলের দিকে ও ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে গল্পের বই পড়তে যায়। আজ সেই ইচ্ছেটাও করছিল না। মাঝে একবার মেট্রন দিদির সঙ্গে একটু গল্প করে এসেছে। দিদির বাড়ি কলকাতার দিকে। ভারী মিশুকে আর মুখে সবসময় হাসি লেগেই আছে। ওর সঙ্গে কথা বলে মনটা তাও একটু যেন হালকা হয়েছে।
সাধারণত এই দিনগুলোতে হোস্টেলে বেশিরভাগ মেয়েরাই থাকে না। ফলে আজ মেসে দু-চারজনের বেশি কাউকেই চোখে পড়লো না। ওরাও সব ফ্রেশার। তাড়াতাড়ি চারটে ভাত খেয়ে ঘরে এসেই শুয়ে পড়েছে পুতুল। গুমোট ভাব দেখে জানালার পাল্লাটা খোলাই রাখলো। সাত-পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই।
হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ওর ঘুম ভাঙলো। ভীষণ জোড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টর্চ দিয়ে দেখলো চারটে বাজতে আর মিনিট দশেক বাকি। দমকা হাওয়ায় জানালার পাল্লা প্রায় ভেঙে পড়ার অবস্থা। কেমন ভয় ভয় করছিল পুতুলের। কারেন্ট আসেনি তখনো। পাল্লাটা বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। একটা বিশালকার কুচকুচে কালো কাক রক্তাক্ত অবস্থায় আছড়ে পড়লো জানালার উপর। জানালার সামনের গ্রিলে ধাক্কা খেয়ে বেচারা পড়লো কার্নিশের উপর। ভয়ে চিৎকার করে উঠলো পুতুল। তড়িঘড়ি জানালাটা বন্ধ করতে যাবে। বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে দেখলো কাকটা একদৃষ্টিতে ওকে যেন দেখছে। কিছু যেন বলতে চাইছে। কাকটার মুখ খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। কাকটার মুখের কাছ দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। তাড়াতাড়ি লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে কুঁজো থেকে একটু জল একটা বাটিতে ঢাললো। সাহসে ভর করে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাটিটা বের করে দিলো জানালার কার্নিশে। আর উপর করে একটু জল ঢাললো কাকটার মুখে। কাকটা যেন ওর কাছে জল চাইতেই এসেছিল। কোনোক্রমে জল খেলো কাকটা। বেচারার অবস্থা দেখে ভারি মায়া হল পুতুলের। ভাবছিলো বেচারাকে ভেতরে এনে রক্ত মুছিয়ে নিজের একটা কাপড় দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে দেবে। হঠাৎ একটা বিরাট জোড়ে বাজ পড়লো। আলোর রোশনাইয়ে যেন জগৎ ভরে গেল। ভয়ে চোখ বুজে কানচাপা দিলো পুতুল। চোখ খুলতেই দেখে কাকটা গায়েব। একটা শিহরণ খেলে গেল পুতুলের। কোথায় গেল কাকটা? উড়ে গেল? নাকি পড়ে গেল নিচে? পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে কারণ কার্নিশটা বেশ বড়। যাক, তাহলে হয়তো বেচারা জল চাইতেই এসেছিল। কিন্তু এক পলকে কিভাবে চলে গেল কোনো শব্দ না করে?
জানালাটা বন্ধ করে, লণ্ঠনটা নিভিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে গেল ও।
দরজার কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলো পুতুলের। দরজা খুলে দেখছে মেট্রনদিদি গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে। পুতুল তোমার ট্রাঙ্ককল এসেছিল। তোমাকে এখুনি বাড়ি যেতে হবে।
ঘন্টা চারেক পরে মা’র অথর দেহটার পাশে অঝোরে কেঁদে চলেছে পুতুল। আশেপাশের সবাই সান্ত্বনা দিচ্ছে ওকে আর দাদাকে। ডুকরে কেঁদে বিলাপের মতো দাদা বলছে ,’ ভোর চারটার আগ আগ দিয়ে হঠাৎ মা’র মুখ দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। মা কাঁদছিলেন আর জল চাইছিলেন। আমি জল দিতে গেলে বারবার ঘোরের মধ্যে বলছিলেন – পুতুল, পুতুল, আমাকে একটু জল দে রে মা। আমার হাতেই জল খেলো মা। তারপর সব শেষ ‘।
নিথর হয়ে গেল পুতুল। তার মানে? মা চলে যাওয়ার আগে? কাকটা? মুখ দিয়ে রক্ত? জল খাওয়ানো?
অজ্ঞান হয়ে গেল পুতুল।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে )
1 thought on “কাকতালীয়”