সপ্তর্ষি নাগ
অবশেষে সেই দিন। একদিন হলেও আমরা শেষমেশ দেখলাম গড়পরতা ভারতীয়র রবিবাসরীয় বিনোদনে ক্রিকেটকে হারিয়ে জায়গা নিল হকি। নিল বললে ভুল হবে। একেবারে নক আউট পাঞ্চ দিয়ে ছিনিয়ে নিলো হৃদয়ের গভীরের জায়গা। ওয়াইড, নো, লেগস্পিন, ওফস্পিন ছেড়ে চায়ের দোকানে বহু বছর থুড়ি দশক পরে ঝড় উঠলো ড্র্যাগ ফ্লিক, পেনাল্টি কর্নার, এরিয়াল পাস নিয়ে। হার্দিক পাণ্ড্যর বিবাহ বিচ্ছেদ নয় বরং হার্দিক সিংয়ের বল হোল্ডিং ক্ষমতা হয়ে উঠলো চায়ের কাপে তুফান তোলার বিষয়। একই দিনে বিরাট -রোহিত খেললেও ১৪০ কোটি ভারতীয়ের পাতে জায়গা পেল হরমনপ্রীত,জরমনপ্রীত, মনপ্রীতরা।যে জার্মান থার্ড আম্পায়ার ওরম একটা একপেশে সিদ্ধান্তে আমাদের অমিত রোহিদাসকে বাইরে পাঠালেন, তাঁর এমন বাপ-বাপান্ত শুরু হল যা শচীনকে ভুল আউট দেওয়ার পরে স্টিভ বাকনারকেও করা হয়নি। একদিন হলেও হরমনপ্রীত সিং হয়ে উঠলেন তামাম ভারতীয়ের নয়নের মনি। আর সৃজেশ – যে রক্ষামন্ত্রী।
নীল অ্যাস্ট্রোটার্ফ এ এগারোজন দামাল ভারতীয় যখন প্রথমদিকে ব্রিটিশ গোলমুখে আক্রমণের লহর তুলছিলো, কোথায় যেন মনে হচ্ছিলো ইস, এই খেলাটাই তো আমাদের জাতীয় খেলা, এই খেলাটাই তো বিশ্বক্রীড়ার দরবারে আমাদের চিনিয়েছিল, এই খেলাই তো আমাদের দিয়েছিলো ধ্যানচাঁদ নামের জাদুকরকে। আসলে হাভাতের মতো কোথায় যেন আমরা বিরিয়ানি পেয়ে নিজের ডাল-ভাতকেই অবহেলা করে চলেছিলাম। ক্রিকেট সুন্দর খেলা, সহজ খেলা, বোধগম্য খেলা আর হ্যাঁ পয়সার ও খেলা। তার সৌন্দর্য তো থাকবেই। কিন্তু মাথা, চোখ, হাত, পা সব দিয়ে এমন গতির এমন সুন্দর টিমগেম হকিকে তাই বলে ব্রাত্য করে রাখতে হবে এমনটাই বা কে বলেছে। এই হকি দিয়েই তো আমরা আজ থেকে ৮৮ বছর আগে বার্লিনে সারা দুনিয়ার সামনে হিটলারের মুখ চুন করেছিলাম, অলিম্পিক ফাইনালে ৮-১ গোলে জার্মানিকে হারিয়ে। তথাকথিত মিত্রশক্তি তখন হিটলারের ভয়ে থড়হরিকম্প।
এদেশে হকি নিয়ে আমরা আপামর জনতার আবেগের তিনটে ধাপ দেখি। প্রথম, ১৯২৮ থেকে ১৯৮০ অবধি মোটামুটি পাঁচ দশক। এই সময় ভারত বিশ্বে একচেটিয়া রাজ করেছে। জাদুকর ধ্যান চাঁদ ছাড়াও এই সময়কালে উঠে এসেছেন বলবীর সিং, উধাম সিং মহম্মদ শাহীদ , ত্রিলোচন সিং, পঙ্কজ গুপ্ত, চরণজিৎ সিং, গুরবক্স সিং, লেসলি ক্লদিয়াস এর মতো লেজেন্ডরা। অলিম্পিকে সোনা না পাওয়াটা আমাদের ছিল জাতীয় ব্যর্থতা। ৮ খানা সোনা, ১টা রুপো আর ৩টে ব্রোঞ্জ নিয়ে অবশেষে আশি নাগাদ সেই স্বর্ণযুগ শেষ হয় অলিম্পিকে সোনা নিয়েই। হয়তো বা আরো দীর্ঘমেয়াদি হত সেই জয়যাত্রা। কিন্তু কোথায় যেন এদেশ সাফল্যে হাঁফিয়ে উঠছিলো। হকি মানেই পদক, হকি মানেই সিংদের বাড়বাড়ন্ত। আর দেশে সেসময় পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাঞ্জাব অগ্নিগর্ভ। আর ৮৩শে ক্রিকেট বিশ্বকাপে অপ্রত্যাশিত জয় দেশকে যেন সন্ধান দিল নতুন স্বর্ণখনির। ক্রিকেট আগেও জনপ্রিয় ছিল বৈকি। ৭১এ বিশ্বত্রাস ক্যারিবিয়ান বোলারদের পাড়ায় গিয়ে খর্বকায় সুনীল গাওস্করের মাস্তানি তো গল্পগাঁথায় চলে গেছে। কিন্তু ছাপোষা ভারতীয়ের লিভিং বা ডাইনিং রুমে ক্রিকেটকে আনতে একটা বিশ্বকাপের দরকার ছিল। একটা কপিল পাঁজির দরকার ছিল। শ্রীকান্ত, বিনি,কিরমানি, অমরনাথ, পাতিল, সান্ধু, আজাদ নিয়ে একটা আসমুদ্র হিমাচল ফিলিং দরকার ছিল, যেটা হয়তো হকি দিতে পারেনি। এরপর তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। তিনি শচীন রমেশ তেন্ডুলকার। এরপর থেকে ক্রিকেটকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে হকি হারিয়ে গেছে পেছনের সারিতে। মাঝের মোটামুটি চার দশক এই অন্ধকার মধ্যযুগের অংশ। অলিম্পিক পদক তো নেইই, উল্টে খেলোয়াড়দের সামগ্রিক মানেও কেমন করে যেন একটা ভাটা পড়তে থাকে। এশিয়াতে সেরার তাজ টিমটিম করে থাকলেও সামগ্রিক মান কেমন ঝপ করে পড়ে যায়। ধনরাজ পিল্লাই দীর্ঘদিন ধরে একা কুম্ভ হয়ে ছিলেন আর মাঝে যুগরাজ সিং, সন্দীপ সিংরা আশার ঝলকানি দেখালেন। কিন্তু সেই সুদিন আর এলো না। যে ভারতের নামে একসময় সোনা বাঁধা থাকতো তারাই অলিম্পিকে যোগ্যতা পর্যন্ত অর্জনে ব্যর্থ হল।
অবশেষে, ২১শে শাপমোচন হল হকিতে। অধরা পদক এলো ৪১ বছর ( অফিসিয়ালি ৪০ বছর, ২০২০র অলিম্পিক কোভিডের কারণে ‘২১ এ হয়)পরে। গ্রুপ লিগে অস্ট্রেলিয়ার কাছে শোচনীয় হারের পরেও গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে আমরা সেবার গ্রেট ব্রিটেনকে হারাই কোয়ার্টার ফাইনালে। সেমিতে বেলজিয়ামের কাছে আবার শোচনীয় হার ৫-২ এ, কিন্তু ব্রোঞ্জ ম্যাচে সর্বস্ব উজাড় করে অবশেষে সৃজেশ, হরমনরা নিয়ে আসেন সেই অধরা মাধুরী। হকিতে ৪০ বছর পরের সেই পদক জয় আমাদের মতো সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে অন্য কোনো ইভেন্টের সোনাজয়ের চেয়ে একবিন্দু ও কম ছিল না। পেয়ে হারানো গৌরবকে পুনরুদ্ধারের শান্তি কি আর বলে বোঝানো যায়!
ফিরে আসি কালকের খেলায়, ফিরে আসি সৃজেশে, যাকে নিয়ে মজে আছে দেশ। একবার ‘এক্স’ হ্যান্ডল খুলে দেখলাম সৃজেশকে নিয়েই উৎসব চলছে। এদেশের অল টাইম গ্রেটদের তালিকায় চলে এসেছেন সৃজেশ। ১০ জন নিয়ে খেলেও ব্রিটিশদের হৃদকম্প ধরিয়ে সেমির বার্থ পাকা করে নিয়েছে ক্রেগ ফুলটনের ছেলেরা। চীনের জিনিসের বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকুক, চীনের পাঁচিল হয়ে কাল একা কিভাবে দেশকে আগলালেন সৃজেশ সেটা যারা দেখলেন কালকের খেলা তারাই জানেন। তারাই জানেন কিভাবে গোলের সামনে সৃ আর মাঠ জুড়ে হরমন কিভাবে গত কয়েক বছর ধরে এই দলকে একসূত্রে বেঁধেছেন। কাল খেলাশেষে হিন্দি কমেন্টেটর দেখলাম আবেগে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন। আর তাঁকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যুগরাজ সিং, ২০০৩ সালে এক দুর্ঘটনা কেরিয়ার শেষ না হলে যিনি হয়তো ভারতীয় হকিতে আরো আগেই নবজাগরণ নিয়ে আসতেন। দৃশ্যটা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলাম না। অহেতুক লাল কার্ড পেয়ে সাইডলাইনে বসে থাকা অমিতের চোখে আনন্দের জল দেখে মনটা সত্যিই চাঙ্গা হয়ে উঠলো। একটা হিসেবে, গতকাল হকি কোয়ার্টার ফাইনাল লাইভ দেখেছেন এদেশের ৫৩ লক্ষ মানুষ। ক্রিকেট ফাইনালের ১৭ কোটি আর আই পি এলের গড়পড়তা ৬ কোটির পাশে কিছুই না। কিন্তু কোথায় জানি আশায় বুক বাঁধছি। এই অপূর্ব সুন্দর খেলা দেখাটা এবার হয়তো আস্তে আস্তে আমাদের রুটিনে আসবে। বেশি মানুষ দেখলে তখনই না স্পনসররা পাতে দেবেন। সবাই তো আর ওড়িশার সেই সজ্জন হকিপ্রেমী নন। জানি না, এবার আমরা পদকবেদির মধ্যমনি হয়ে শেষ করব কিনা, জানিনা আদৌ পদক আসবে কিনা। কিন্তু এই দলকে বিশ্বাস করতে বড় মন চাইছে। সৃজেশ, হরমনরা রূপকথা লিখবে সেটাই বিশ্বাস করতে মন চাইছে। ছোটবেলার বন্ধু গুলুর ফোন এলো। বেটা বড় মাস্তান আজকাল। জিজ্ঞেস করছে, হ্যাঁ রে, এই স্টিকটা দিয়ে তো লোক পেঁদাতে হয় জানতাম, অত সুন্দর শিল্প ও হয়? ফিরছে, হকি ফিরছে।
khub valo laglo sir lekhata… akbar pore mon voreni… 4 bar porlam… apnar lekhonshoily ke nomon janai…pronam neben .
❤️❤️🙏🙏