কলমে – সুপ্রভা সরকার
সদ্য কলেজ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই সুচরিতা,সুস্মিতা,সোনালি,রানি চার বন্ধু মিলে ওদের স্কুলের বড়দিমণি বাংলার শিক্ষিকা শ্রীমতী কাজল ব্যানার্জীর সাথে দেখা করতে এসেছে।
কলিং বেলটা বাজতেই বড়দিমণির বাড়ির পরিচারিকা তাড়াতাড়ি এসে দরজাটা খুলে দিতেই ঘরের ভেতর থেকে বড়দিমণির আবেগি কন্ঠস্বর, -‘এসো,ভেতরে এসো সবাই’।
সুচরিতারা ভেতরে যেতেই ঘরের মধ্যে এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল।
সবাই চা শেষ করতেই বড়দিমণি বললেন, ‘চলো আজ তোমাদের সারা জঙ্গিপুর ঘুরে দেখাব’।
সবাই একটু ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
সুচরিতা বলে উঠল, ‘আমাদের এই জঙ্গিপুর ঘুরে নতুন করে আর কী দেখব? সবই তো আমাদের চেনা-জানা’।
বড়দিমনি বললেন, ‘তোমরা যখন জঙ্গিপুরের সব কিছুই চেনো-জানো তাহলে বলতো এই জঙ্গিপুরের এমন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি একইসঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রেসের মালিক আবার সংবাদপত্র বিক্রেতাও বটে’।
সুচরিতা বলে, ‘জঙ্গিপুরে অনেক বিশিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন আর এখনও বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন ঠিকই কিন্তু আপনি যেরকম বলছেন তেমন ধরনের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা তো আমার জানা নেই’।
বাকিরাও সবাই মাথা নাড়ায়।
বড়দিমনি বলেন, ‘তোমরা “দাদাঠাকুরের” নাম শুনেছ’?
সুস্মিতা বলল, ‘রঘুনাথগঞ্জে বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাদাঠাকুর মোড় বলে একটা জায়গা আছে, আর ওখানে এক ব্যক্তির স্ট্যাচু ও আছে’।
অদিতি বলল, ‘তাহলে ঐ স্ট্যাচুটি যে ব্যক্তির তিনিই কী “দাদাঠাকুর”?’
বড়দিমণি হাসতে হাসতে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ অদিতি’।
সুচরিতা বলে, ‘কে এই দাদাঠাকুর, বড়দিমণি? পথের মাঝে যাঁর স্ট্যাচু আছে অথচ আমরা তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানিই না’।
বড়দিমণি বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলব বলেই তো তোমাদের এতকিছু জিজ্ঞাসা করছি’। এই দাদাঠাকুর ওরফে শরৎচন্দ্র পন্ডিত ছিলেন আমাদের জঙ্গিপুরের তৎকালীন সময়ের নামকরা ব্যক্তি, – যিনি সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রেসের মালিক আবার সংবাদপত্র বিক্রেতা’।
সোনালি বলে, ‘শরৎচন্দ্র পন্ডিত…! – এই নাম তো কখনও শুনিনি’।
বড়দিমণি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘হ্যাঁ, বাঙালি তো আজকাল বাঙালিকেই মনে রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আর আজকালকার ছেলেমেয়েদের কথা আর কী বলব, এরজন্য অবশ্য তোমাদের পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। আমাদের অতি আধুনিক সমাজ এগোতে গিয়ে পেছনের মানুষদের কথা ভুলে গেছে। যাকগে যা বলছিলাম, – এই জঙ্গিপুরের সাথে দাদাঠাকুর ওরফে শরৎচন্দ্র পন্ডিতের কত বছরের পুরনো ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এই দাদাঠাকুরের জন্ম- ইংরেজি 1881 খ্রিস্টাব্দে/বাংলা ১২৮৮ সনের ১৩ই বৈশাখ বীরভূম জেলার নলহাটি থানার শিমলান্দি গ্রামে তাঁর মামাবাড়িতে, পৈতৃক নিবাস ছিল ঐ নলহাটি থানারই ধর্মপুর গ্রামে। পরে অবশ্য পারিবারিক বিবাদের জেরে তাঁর পিতামহ ঈশানচন্দ্র পন্ডিত পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আমাদের মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মহকুমার দফরপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাই বলতে গেলে দফরপুরই দাদাঠাকুরের পৈতৃক বাসস্থান। জাতিতে ব্রাহ্মণ শরৎচন্দ্র পন্ডিতের বাবা ছিলেন হরিলাল পন্ডিত আর মা তারাসুন্দরী দেবী। খুব ছোটবেলায় বাবা, মা কে হারানোর পর কাকা রসিকলালের কাছে মানুষ হন। জঙ্গিপুর হাইস্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে বর্ধমান রাজ কলেজে এফ.এ ক্লাসে ভর্তি হয়েও আর্থিক টানাপোড়েনে পড়া শেষ করতে পারেননি’।
রানি হঠাৎ বলে, ‘দাদাঠাকুর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি, সে তো বুঝলাম। কিন্তু নিউজ পেপারই কেন প্রকাশ করলেন? অন্য কিছুও তো করতে পারতেন’।
বড়দিমণি বলতে শুরু করলেন, ‘সে সময় আমাদের জঙ্গিপুরে কোন ছাপাখানা ছিল না। তাই দাদাঠাকুর ঠিক করেন একটা ছাপাখানা খুলবেন। 1903 খ্রিস্টাব্দে/১৩১০সনে কলকাতার ভোলানাথ দত্তের কাছ থেকে একটি প্রেস কিনে নিজের দফরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন “পন্ডিত প্রেস”। প্রথমে তিনি প্রিন্টার্স গাইড বই দেখে ছাপাখানার কাজ শেখেন। প্রথমদিকে বিভিন্ন চেক-দাখিলা, নিমন্ত্রণের কার্ড, প্রীতি উপহার কার্ড ইত্যাদি ছোটখাটো ছাপার কাজ করতেন। পরে 1911 খ্রিস্টাব্দে/১৩১৮ সনে আরও উন্নত মানের একটি প্রেস কিনে গ্রাম থেকে উঠে রঘুনাথগঞ্জে এসে “পন্ডিত প্রেস” স্থাপন করেন। সেই সময় জঙ্গিপুর-রঘুনাথগঞ্জে কোন সংবাদপত্র ছিল না। মাত্র 22 বছর বয়সেই দাদাঠাকুর পুরোপুরি নিজের উদ্যোগে তাঁর প্রেস থেকে সাপ্তাহিকভাবে “জঙ্গিপুর সংবাদ” নামে একটি সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশ করেন 1914 খ্রিস্টাব্দে/১৩২১ সনের ৫ই ভাদ্র। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে “জঙ্গিপুর সংবাদের” বয়স 107 বছর। এই পত্রিকা বাংলার মফস্বলের বলিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রথম উদাহরণ। প্রথমে এই পত্রিকার প্রধান আয়ের উৎস ছিল- মুনসেফ আদালতের বিজ্ঞাপন। তিনি তো খুব কাব্য রসিক ছিলেন তাই কাব্য করে নিজের প্রেসের বর্ননা নিজেই দিয়েছিলেন’।
‘কীরকম, কীরকম…’ অদিতি খুব এক্সাইটেড হয়ে ওঠে।
‘দাদাঠাকুরের কথায়, “আমার ছাপাখানার আমিই প্রোপাইটর, আমি কম্পোজিটর, আমি প্রুফ রিডার, আমিই ইঙ্কম্যান, কেবল প্রেসম্যান আমি নই- সে ম্যান নয়, উইম্যান, অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী”- বড়দিমণি হাসতে হাসতে বলেন।
সুস্মিতা জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা বড়দিমণি, সেইসময় পরাধীন ভারতে মুর্শিদাবাদে হঠাৎ করে সংবাদপত্র প্রকাশের কী কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে ছিল?’
‘উদ্দেশ্য তো ছিলই, দাদাঠাকুর ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন, এছাড়াও বিপ্লবীদের আস্তানাও ছিল এই পন্ডিত প্রেস। দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি দাদাঠাকুর খুব কর্তব্যনিষ্ঠ ছিলেন। সেজন্য অবশ্য তিনি অনেক বিপাকেও পড়েন। একসময় ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও তাঁর পিছু নিয়েছিল। দাদাঠাকুর এমন মানুষ ছিলেন যিনি চাণক্য নীতির কূটকৌশলে তথাকথিত উচ্চবর্গের আভিজাত্যধারীদের সব গর্ব খর্ব করেছিলেন’।
‘তারমানে দাদাঠাকুর খুব উঁচু দরের মানুষ ছিলেন’-অবাক হয়ে সোনালি বলে।
‘হ্যাঁ, সে আর বলতে, -বড়দিমণি বলেন, -‘দাদাঠাকুরের প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা গুলিতেও বিভিন্ন মেজাজের লেখা বেরোতো। এই যেমন ধরো, 1922 খ্রিস্টাব্দে/১৩২৯সনে “বিদূষক” পত্রিকাটি সাপ্তাহিক ভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি “ধামাধরা উদয়পন্থীদের মুখপাত্র” বলে পরিচিত ছিল। এই পত্রিকার প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাটি ছিল ভারী চমৎকার, -ব্রাহ্মণ পন্ডিতের একটি ব্যঙ্গ চিত্র- তাঁর কপালে “দুঃখ”, বক্ষে “দুরাশা” আর উদরের উপরে লেখা থাকত “উদর রে তুঁহু মোর বড়ি দুশমন”। এডিটর শব্দটি “Aid-eater” বলে ছাপা হত। প্রথম একবছর “বিদূষক” পত্রিকাটি জঙ্গিপুরের পন্ডিত প্রেসে ছেপে কলকাতায় গিয়ে ফেরি করতেন। ধীরে ধীরে বিদূষকের আস্তানা তৈরি হয় কলকাতার ১৯৫নং মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে। সেই সময় কলকাতার বাগমারীতে বাসা নিয়ে সেখানেও আর একটি ছাপাখানা খুলে 1924 খ্রিস্টাব্দে/১৩৩১সনের বৈশাখ মাস থেকে “বিদূষকে”র দ্বিতীয় বর্ষের সংখ্যা ছাপানো হতে থাকে। তৎকালীন কলকাতা কর্পোরেশনের CEO নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নিজে থেকেই হকার লাইসেন্স করে দিয়েছিলেন দাদাঠাকুরকে। আর সেই সময় “বিদূষকে”র দাম মাত্র ১ আনা মানে তখনকার ৪ পয়সা’।
রানি জিজ্ঞাসা করে, ‘বিদূষকে লেখার ধরন কেমন ছিল? গল্প, কবিতা লেখা হত নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় লেখা হত’?
বড়দিমণি বলেন, ‘বিদূষকের পাতায় কবিতা ও ছড়ার মজাদার সমাচার থাকত। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি, বিশেষ বিশেষ খবর সব কবিতার মধ্যে দিয়ে লিখতেন দাদাঠাকুর নিজেই। বিদূষকের পাতায় পাতায় সমাজসংস্কারের বহু চেষ্টা করে গেছেন তিনি। এছাড়াও 1925 খ্রিস্টাব্দে/১৩৩২সনে “বোতল পুরাণ” নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি, যেটা ছিল মাতালদের উদ্দেশ্যে মদ্যপান বিরোধী পত্রিকা’।
‘সেটা কীরকম?’-জিজ্ঞাসা করে অদিতি।
বড়দিমণি রাস্তার পাশে একটু দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বোতল পুরাণে বোতলের আকারে কালো রঙের মোটা কাগজ কেটে তারই মলাটের ভিতরে লাল রঙের কাগজে মাতালদের উদ্দেশ্যে ছাপানো একটি কবিতা। দেখতে ঠিক যেন একটি বোতল। দাদাঠাকুরের বোতল পুরাণের দাম ছিল ২আনা। কলকাতার রাস্তায় দাদাঠাকুর যখন এই বোতল পুরাণ ফেরি করতেন তখন গাইতেন-“আমার বোতল নিবি কে রে? /এই বোতলে নেশাখোরের নেশা যাবে ছেড়ে।/বোতল নিবি কে রে?”
সুস্মিতা বলে, ‘ঐ সময়ে তো অনেক পত্র- পত্রিকা ই ছিল, তাহলে দাদাঠাকুরের পত্রিকার কথাই এত গুরুত্ব দিচ্ছেন যে..’
‘বলছি এইকারণে যে,- সেসময় মুর্শিদাবাদ তো বটেই সারা বাংলায় দাদাঠাকুর ই ছিলেন একমাত্র সংবাদ পত্রের সম্পাদক যিনি নিজের কাগজ নিজেই কম্পোজ করতেন, প্রুফ রিডিং করতেন, ছাপতেন আবার কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফেরিও করতেন’।
‘সত্যিই উনি অতুলনীয়’-বিস্মিত হয়ে বলে রানি।
‘শেষ বয়সে মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে থাকতেন বলে নিজেই নিজেকে “ঘর-শশুর” বলে পরিচয় দিতেন,-সবেতেই তাঁর রসিকতা’। -হাসতে হাসতে বলেন বড়দিমণি।
‘অবশেষে ৮৭ বছর বয়সে 1968 খ্রিস্টাব্দে/১৩৭৫ সনের ১৩ই বৈশাখ এই রসিক দাদাঠাকুরের মৃত্যু হয়। ১৩ই বৈশাখ জন্ম আবার ১৩ই বৈশাখেই চলে গেলেন, আসা-যাওয়ার দিনেও রসিকতা করতে ছাড়েননি তিনি।
সুচরিতা আক্ষেপ করে বলে, ‘এত বড়ো ব্যক্তিত্ব… অথচ আমরা কিছুই জানতাম না। সমাজে দাদাঠাকুরের অবদান ভোলার নয়’।
‘ঠিকই বলেছ সুচরিতা, সারাজীবন দাদাঠাকুর দাপটের সঙ্গে সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন, নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমেই তাঁর ভরসা ছিল। চারিত্রিক দৃঢ়তা, ইস্পাতের মতো কঠিন মনোবল নিয়ে সমাজের সেবা করে গেছেন, কখনো কারও কাছে অনুগ্রহ ভিক্ষা করেননি’।
ততক্ষণে হাঁটতে হাঁটতে সকলে ‘পন্ডিত প্রেসে’র সামনে এসে পড়েছে।
বড়দিমনি বললেন, ‘চলো, প্রেসের ভেতরে গিয়ে দাদাঠাকুরেরই এক উত্তরসূরি যিনি “পন্ডিত প্রেসের” বর্তমান কর্নধার তাঁর সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই, -তাঁর কাছে দাদাঠাকুরের আরও অনেক অজানা কথা জানতে পারবে তোমরা’।
‘ভুলে যাওয়া বাঙালি’ এই শিরোণামে প্রতি বুধবার ও রবিবার আমাদের ওয়েবসাইট www.saptarshinag.in এ প্রকাশিত হবে একটি করে অধ্যায় | আর সেই লেখা হবে তোমাদের | বাংলার এমন কৃতি সন্তানরা যাঁদের আজ মানুষ ভুলে গেছে তাঁদের নিয়ে গবেষনামূলক লেখার সিরিজ এটি | লিখতে হবে বাংলায় | সেরা লেখাগুলো স্থান পেতে পারে kindle এ প্রকাশিত বইয়ে | তাই চটপট পাঠিয়ে দাও নিজের লেখা nagsaptarshi@gmail.com এই মেইল আইডি তে | ওয়ার্ড ফাইল এ শুধুমাত্র পাঠানো যাবে লেখা | লেখার গুণমান বিচার করে শুধুমাত্র ভালো লেখাই কিন্তু প্রকাশ পাবে | শব্দের কোনো সীমারেখা নেই | লেখা পাঠানোর ও ডেডলাইন নেই | এই সিরিজকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব ও তোমাদের |