অনবদ্য,অপূর্ব বহুরূপী

সপ্তর্ষি নাগ

বাংলা ছবি নিয়ে বাংলায় রিভিউ লিখছি, এটা বিশ্বাস করতে নিজেরই বেশ কষ্ট হচ্ছে | বছর দুয়েক আগে মোহিত হয়েছিলাম ‘অপরাজিত’ দেখে | কিন্তু সেটা হলে গিয়ে দেখা হইনি | ott তে বারকয়েক দেখে তবে গিয়ে আশ মিটেছিলো | আর তাছাড়া আজকালকার বাংলা ছবি মানেই predictable কিছু কাজ | হয় পরকীয়া, নয় থ্রিলারের নামে কপি করা তাও আবার জঘন্য রুচির, নইলে চিবিয়ে কথা বলা আর নইলে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে ওভারস্মার্ট হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা আর সেই একঘেয়ে ড্রোন শট নইলে স্লো মো‘র বাড়বাড়ন্ত | বেশ কিছু পরিচালক আবার দেখতাম ক্যামেরায় এসে কাঁদুনি ও গায় যে দর্শক ওদের ছবি ছেড়ে কেন বিদেশী ওপেনহাইমার দেখে, বা দেখে বলিউডের মসলা ছবি | নন্দিতা-শিবপ্রসাদকে এই তালিকায় আমি কোনোদিন রাখিনি | আরে বাবা কাজ ভালো করলে দর্শক এমনিতেই আসবে | কাঁদুনি গাইতে হবে না | যখন দেখছি জলপাইগুড়ির মাল্টিপ্লেক্স হাউসফুল চলছে আর ’বহুরূপী‘র কিছু সিনে লোক তালি আর সিটি দিচ্ছে, মনে হল ওইসব কাঁদুনি না গেয়ে কনটেন্ট এ জোড় দিলে সেই সব পরিচালক বাংলা ছবি বা নিজেদের ও অনেক উপকার করতেন | যখন দেখছি জলপাইগুড়ির মতো ছোট শহরে আলিয়া ভাটের ওভারহাইপড ’জিগরা‘ শো পাচ্ছে না আর ’বহুরূপী’ লোকে চুটিয়ে দেখছে আবার সেই কথাই মনে হল ‘Content is the king’, মানুষের পছন্দ নিয়ে ব্ল্যাকমেলের কোনো জায়গাই নেই |

এবার আসি ছবির রিভিউতে | আশা করি এতক্ষণে সকলেই জেনে গেছেন, এক ব্যাঙ্কডাকাত আর তার দলবল আর এক সৎ পুলিশ অফিসারের সেই ক্লাসিকাল ‘Cat and mouse’ এর গল্প এটা | শুরুর দিকে বেশ আড়ষ্ট লাগছিলো ছবির গতি | কিন্তু একটা ভালো ছবির বৈশিষ্ট্য তো এটাই | এই বিল্ড আপটাই তো আমরা ভালো থ্রিলারে এতদিন দেখে এসেছি | চমক দিতে গেলে থ্রিলারের কি হাল হয় তার উদাহরণ তো ইদানিংকালের বাংলা থ্রিলার বা ott র গাদাগাদা হিন্দি থ্রিলার তো আছেই | যাই হোক, শুরুর প্রত্যেকটা আড়ষ্টতা ধীরে ধীরে নিজের আসল রূপ পেতে সময় নেয় আর তখনই ছবিটা ভালো লাগতে শুরু করে | অদ্ভুত সুন্দর একটা গল্প যেখানে থ্রিলারের মোড়কে ভালোবাসা, পরিবার, সততা, সিস্টেম নিয়ে সমালোচনা সব আসে একে একে | কিছু জায়গায় ‘জওয়ান’ এর সিস্টেম বিরোধী দিকটাও চোখে পড়ে | প্রতিটা ছোট রেফারেন্স পরিচালকদ্বয় দারুণ মুন্সীয়ানায় মিলিয়ে দিয়েছেন | কি অপূর্ব চিত্রনাট্য! আহা ! হয়তো বা এটা বর্তমান যুগে বাংলা ছবির একটা বেঞ্চমার্ক হয়ে গেল | ঠিক কি কি মশলা যথাযথ পরিমাণে মেশালে একটা ‘বহুরূপী’ তৈরি হয় |

অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে শিবপ্রসাদকে নিয়েই এক ঘন্টা কেটে যাবে | অদ্ভুত, অপূর্ব, অনবদ্য, অসাধারণ | কেন এই মানুষটাকে আমরা আরো বেশিকরে অভিনয়ে দেখি না? একটা মানুষকে সিস্টেম এতখানি অত্যাচার করলেও নিজের প্রতিহিংসাকে ভালো-খারাপের লড়াইএ ভালোর হারে না ব্যবহারের যে অদ্ভুত আনন্দ তার এত সুন্দর অভিব্যক্তি দীর্ঘদিন অন্তত বাংলা ছবিতে দেখা যায় নি | আপনি আরো,আরো অভিনয় করুন | নন্দীতাদি পরিচালনা করবেন আর আপনিও তাতে থাকবেন কিন্তু আপনার অন্তত একটা করে ছবি ফি বছর না পেলে হবে না শিবুদা | আবীরকে প্রথম আমার আজ ভালো লাগলো, যেখানে ও টাইপকাস্ট হয়নি | পরিচালকের মুন্সীয়ানায় আবীর এই ছবিতে নিজেকে ছাপিয়ে গেছে কারণ একবার ও সে অতিরিক্ত কিছু করতে যায় নি | কৌশানির উচ্চারণ কিছু জায়গায় একটু শ্রুতিকটূ লাগলো আর বড্ড ফোর্সড মনে হল | তাছাড়া কিন্তু ও অসাধারণ | জানিনা এই মেয়েটিকে বাংলা পরিচালকরা ঠিক কিভাবে ব্যবহার করেন, ঠিক পাত্রে পড়লে ও কিন্তু অসাধারণ | বৌদির সঙ্গে শিবপ্রসাদের শেষ দিকের একটা সিনে পাশ থেকে কৌশানির এক্সপ্রেশন দেখে আমি রীতিমতো অভিভূত | আর একটা চটুল গানে ওর আবেদন লাস্যের মাত্রা অতিক্রম না করেও চূড়ান্ত আকর্ষণীয় | বরং ঋতাভরীকে একটু জড় লাগছিলো এদের মাঝে | আমি ওর আগের কোনো কাজ দেখিনি | তবে মনে হয় অভিনয় আর অত্যাভিনয় এই দুটোর ফারাক ওর জলদি বোঝা উচিত | হয়তো বা ওই এই ছবির অভিনয়গত দিকে একটা বড় ত্রুটি |

টেকনিকাল দিকগুলোতে খুঁত ধরতে চাইলে অনেককিছু বলা যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা একটা আর্থিকভাবে দুর্বল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ছবি | এরকম ছবি আরো দশটা এলে তবে হয়তো আমরা একদিন বাংলা ছবিকে টেকনিকাল বিষয় নিয়ে সমালোচনা করবো | তবে স্বল্প বাজেটের একটা ছবি যা পেলাম তাই উপভোগ করলাম | মোটের উপর স্বল্প পরিসরেও প্রায় সত্তরের নন্দীতাদি আর পঞ্চাশের শিবপ্রসাদ আমাদের যে এতটা দিতে পারলেন তাই যথেষ্ট আর সেটাই রেফারেন্স হয়ে থাকুক অতিবোদ্ধা বাকি পরিচালকদের কাছে যারা একসময় ফাঁকা মাঠেও গোলহীন ছিলেন |
একটা কথা বলা হয়নি, এত কম খরচের মেকআপ কিন্তু কতটা দুর্দান্ত সেটা ক্লাইম্যাক্স সিনে দর্শকরা ফিল করবেন |
পরিশেষে ছবির দুর্বলতা | রানটাইম বড্ড বেশি | ছবিটা অনায়াসে দশে নয় পেতে পারতো কিন্তু আধা নম্বর কাটতে হচ্ছে এডিটিংএর দুর্বলতার জন্য | আর পনেরো মিনিট কাটা গেলেই হয়তো এটা একটা কালজয়ী মাস এন্টারটেইনার বাংলা ছবি হতে পারতো | আর কমেডিগুলো একটু ফোর্সড | নির্ভেজাল কমেডি সেই সত্তরের দশকের পরে অনেকটাই চুপ হয়ে আছে | কিন্তু নন্দিতা-শিবু জুটি যেভাবে কাজ করছে আর যে ভাবে ছক ভাঙছে প্রতিবছর, কে বলতে পারে ওনারাই হয়তো কমেডি ছবিতেও বাংলায় নতুন জোয়াড় আনবেন |
‘‘বহুরূপী’ হলে গিয়ে দেখুন, ন্যাকামো না করেও,পাবলিসিটি স্টান্ট না মেরেও, চিবিয়ে না কথা বলেও,ফুটেজ না খেয়েও যে দর্শক টানা যায় একবার না হয় সেটা দেখতেই যান I
আমার তরফে দশে সাড়ে আট

News Reporter

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *