সপ্তর্ষি নাগ
তুষারস্নাত পহেলগাঁও এর উপর দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ দৃপ্ত ভঙ্গিমায় হেঁটে চলেছেন ফেলুদা আর তার দুই শাকরেদ আর ব্যাকগ্রাউন্ডে চলছে সেই কালজয়ী ফেলুদা থিম। আহা! এমন সুন্দর উপস্থাপনায় ফেলুদাকে দেখবার জন্য কত বছর যে হাপিত্যেশ করে বসে ছিলাম। কিন্ত আজকালকার বাংলা ছবির নির্মাতাদের মাথায় যে কি পোকা নড়ে! যাকে ব্যোমকেশ বানাচ্ছে পরের ছবিতে তাকেই ফেলুদা বানিয়ে দিচ্ছে! আজব! কিন্তু এবার ফেলুদা সত্যিই অন্যরকম। এক্কেবারে ফেলুদারই মতন। আর বছরে কয়েকখান জঞ্জালমার্কা টুকে বানানো ছবি করা সিজিদ্দা থুরি সৃজিতও নিজেকে ফিরে পেলেন রায়কর্তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে, ফেলুদার বেশি আধুনিকীকরণ না করে কপিবুক স্টাইলে খেলে। সব মিলেমিশে ভুস্বর্গ এবার সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো।
গতকালই হইচই প্লাটফর্মে এলো সৃজিত পরিচালিত ওয়েব সিরিজ ভুস্বর্গ ভয়ঙ্কর। ফেলুদার ভূমিকায় বাংলার ব্রাত্য অভিনেতা টোটা। অপরূপা কাশ্মীরের পটভূমিতে সত্যজিতের অন্যতম কমপ্লেক্স ফেলুদাকাহিনী এটা। ওঁনার প্রায় শেষবয়সে লেখা এবং এই লেখা থেকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেলুদা চরিত্রে আর লেখনভঙ্গীতে কিছু পরিবর্তন পাই। ভালো না খারাপ তা বিচারের স্পর্ধা কোনো মরণশীলের নেই কারণ ফেলুদা আর তাঁর স্রষ্টা দুজনেই অমরত্ব পেয়ে গেছেন সৃষ্টির জগতে, কালের খতিয়ানে। যাই হোক, মোট ৬টা পর্বে ২ ঘন্টা ২৪ মিনিটের রানটাইম এই সিরিজটার। তাহলে এত সুন্দর প্রোডাকশন ভ্যালু নিয়েও সৃজিত কেন এটাকে বড় পর্দায় আনলেন না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। নাকি অ্যানিমাল, পুষ্পা, খাদানের মতো তথাকথিত ‘মাসি’ না চাষি কি যেন বলে সেটা হবে না বলে পিছু হটলেন তিনি? আরে ঠিকভাবে আনলে এই ভূভারতে ফেলুদার চেয়ে বড় ‘মাসি’ ক্যারেক্টার আর কেউ আছে? কিছু দৃশ্য দেখতে দেখতে বড় পর্দা বড়ই মিস করছিলাম।
চলে আসি সিরিজটার ভালো দিকগুলোতে। অসাধারণ প্রোডাকশন ভ্যালু। বাজেটে কোনো কমতি রাখেননি প্রযোজক। প্রায় পুরোটাই শুটিং মনমোহিনী কাশ্মীরভ্যালিতে। ইদানিং সৃজিত ড্রোনশট পুরো হাস্যকরভাবে ব্যবহার করছিলেন। এই সিরিজে ড্রোনশটে দারুণ মুন্সীয়ানার ছাপ রেখেছেন তিনি। তবে এই ছবিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর কিন্ত পাবেন টোটা। এই মানুষটাকে টলিউড ব্রাত্য রেখেছে, ভাবা যায়! বলতে দ্বিধা নেই, ফেলুদার সেই পেটানো চেহারা, বুদ্ধিদ্বীপ্ত চাহনি, সুক্ষরসবোধ, ধারালো কণ্ঠ, সিগারেট খাওয়ার সেই সিগনেচার স্টাইল সবকিছুতে টোটা অসাধারণ। আর সেই অসাধারণত্ব এতটাই পর্যায়ে যে আমি এই সিরিজের ফেলুদাকে সৌমিত্রর ঠিক পরেই রাখতে বাধ্য হচ্ছি। সব্যসাচী? না মশাই, পেটানো চেহারা ছিল না। টোটাকে দেখতে দেখতে আমি বারকয়েক সত্যজিতের আঁকা ফেলুদার স্কেচ ও দেখছিলাম। অবিকল সেই ফেলুদা। টোটা আসলে বাংলা ছবি হারায়নি। হ্যাংলামার্কা বাংলা ছবি টোটার লেভেলের একজন অভিনেতাকে হারিয়েছে এতদিন। জজ মল্লিকের চরিত্রে রজতাভ বেশ মানানসই আর তাঁর অভিনয় নিয়ে তো কিছু বলারই নেই। সপ্রতিভ, সাবলীল। তোপসের রোলে ছেলেটিকে শুরুতে একটু অপ্রতিভ লাগছিলো বই কি কিন্তু ধীরে ধীরে ভারি মিষ্টি লাগে ওকে। ওকে বেশি ডায়লগ দেননি সৃজিত। দিলে হয়তো ওকে আরো ভালো লাগতো। সিরিজটার চিত্রনাট্য বেশ ঝরঝরে, নির্মেদ। শুরুতে একটু হোঁচট খেলেও তাড়াতাড়ি সামলে নিয়েছেন সৃজিত। অহেতুক লম্বা না হওয়াতে একবারে দেখে ফেলা যায় ৬টা পর্ব। আর ফেলুদার হাতে মোবাইল না ধরিয়ে সেই আশির দশকের শেষদিকের সময়কেই রেখেছেন পরিচালক। এরফলে ফেলুদার সঙ্গে সহজেই কানেক্ট করতে পারবে আমাদের মতো বিশ্বস্ত পাঠকরা। এই কপিবুক স্টাইলে ফেলুদাকে উপস্থাপন করাটাই টোটা আর প্রোডাকশন ভালুর পাশে সিরিজটার USP।
এবার আসি খারাপ দিকগুলোতে। পুরোনো সময়কে দেখাতে গিয়ে কালার গ্রেডিয়েন্ট একেবারে গুলিয়ে ফেলেছেন সৃজিত। সেপিয়ার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ভুস্বর্গের আসল সৌন্দর্যকেই ফোটাতে পারেনি। সবুজভাবটা পুরোটাই মিসিং আর কেমন একটা ম্যাড়ম্যাড়ে নীলের বাড়াবাড়ি যা বড্ড দৃষ্টিকটূ লাগছিলো। অনির্বান চক্রবর্তী একেনবাবুই, লালমোহনবাবু নন। দাড়ি থাকলেই তো আর… তেমনি টাক থাকলেই কি লালমোহনবাবু হওয়া যায়! সেই গোঁফের ফাঁকে হাসি, সেই শারীরিক ভাষা, সেই কৌতুক – নাহ লালমোহনবাবু একজনই ছিলেন। পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতারা যথেষ্ট অতি অভিনয় করেছেন যেটা টোটা বা রজতাভের লেভেলের পাশে বেশ বেমানান। এই তালিকায় ঋদ্ধি সেন ও আছেন। কিছু ডায়লগ আরেকটু স্মার্ট হলে বা ন্যাচারাল হলে আরো জমতো। বড্ড ক্লিশে লাগছিলো কিছু জায়গা।
নেগেটিভগুলো বাদ দিলে কিন্তু যথেষ্ট জমজমাট এবারের ফেলুদা। অনেক, অনেক দিন পরে। ট্রেলার দেখে লোভ সামলাতে না পেরে রাতেই দেখা শেষ করে সকালেই রিভিউ দিলাম। ফেলুদাকে ফেলুদার মতো দেখতে পেলে আহ্লাদে আটখানা হবে না এরম বাঙালি আছে নাকি? আজকেই দেখে নিন ভুস্বর্গ ভয়ঙ্কর। সিজিদ্দা, আবার থুরি, সৃজিত আর এককথায় অনবদ্য টোটার জন্য অন্তত।
রেটিং? না হে, ফেলুদার জন্য রেটিং না বরং সেই বছর বারোর কিশোরের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর বল্গাহীন আবেগটাই থাক।